X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ, অনশনে অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকরা

এস এম আববাস
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২১:১০আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৩

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এসিটি শিক্ষকদের অনশন

রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পাওয়া দেবাশীষ পণ্ডিত চলে গেছেন অন্য পেশায়। শুধু তিনি নন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বর্ণপদক পাওয়া আরও কয়েকজন শিক্ষকও পেশা ছেড়েছেন। অন্য যাদের চাকরির বয়স ছিল, তাদের মধ্যে দেড় শতাধিক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এখন ক্যাডার সার্ভিসে। আর যাদের সরকারি চাকরির বয়স নেই, তারা বাধ্য হয়ে এই পেশায় রয়েছেন চৌদ্দ মাস ধরে বিনা বেতনে। অথচ এদের সবাই মাস্টার্স পাস এবং তাদের নেওয়া হয়েছিল মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে। অতিরিক্ত শ্রেণি-শিক্ষক (এসিটি)  হিসেবে পরিচিত এই মেধাবীদের দাবি, মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ দিয়ে তাদের সঙ্গে করা হয়েছে প্রতারণা, নিয়োগ স্থায়ী করার কথা বলে সরকার এখন তাদের নিয়ে খেলছে।

সেকেন্ডারি এডুকেশন অ্যাকসেস অ্যান্ড এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ) নামের প্রকল্পটিতে ২০১৫ সালে পাঁচ হাজার ২০০ জন মেধাবীকে অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক (এসিটি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হলে শর্ত অনুযায়ী চাকরি ধারাবাহিকতা রক্ষা না করায় এসব শিক্ষক প্রতারণার শিকার হন। তবে চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষার আশ্বাস দেওয়ায় তারা এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু, ১৪ মাস ধরে তারা বেতন পাননি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই উদাসীনতার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করা এসব শিক্ষক এখন নেমেছেন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে চাকরির নিশ্চয়তার দাবিতে গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে গণ অবস্থান ও অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন এসব শিক্ষকরা। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নতুন মেয়াদে সরকার গঠনের পর গত দুই মাসে এটিই বড় ধরনের দাবি আদায়ের দ্বিতীয় আন্দোলন। এর আগে গত জানুয়ারিতে মজুরি সংক্রান্ত ইস্যুতে আন্দোলনে নেমেছিল পোশাক শ্রমিকরা। পোশাক কারখানা মালিকদের সঙ্গে মধ্যস্থতার মাধ্যমে সফলভাবে এর সুরাহা করে সরকার।

এসিটি শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুযোগ পেয়ে হাজার খানেক শিক্ষক এ পেশা ছেড়ে দিলেও এখনও চার হাজারের বেশি শিক্ষক সরকারের আশ্বাসের ওপর ভিত্তিতে পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন। তাই তাদের জীবিকা নিশ্চিত করতে চাকরির নিশ্চয়তা পাওয়া জরুরি।

এসিটি শিক্ষকদের অভিযোগ, শিক্ষকদের ধরে রাখতে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ থাকলেও দীর্ঘ সময়েও সমাধান দিতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আইনি জটিলতার কারণে এসব শিক্ষকদের বিষয়টি সমাধান করা যায়নি। জনবল কাঠামো অনুযায়ী এসব শিক্ষককে এমপিও দেওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকদের চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষায় অন্য একটি কর্মসূচি ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি)’ প্রকল্পের আওতায় নিতে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ২০০০ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী প্রকল্প শেষে হলে প্রয়োজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে পদ সৃষ্টি করা যায়। অথচ শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। বেশি বেশি প্রকল্প তৈরি করে তা লাভজনক দেখিয়ে এক শ্রেণির আমলারা আর্থিকভাবে লাভবান হন এবং পদোন্নতির সুযোগ তৈরি করেন। এ কারণেই এসিটি শিক্ষকদের অর্জন ব্যবহার করে আমলাদের কেউ কেউ লাভবান হয়েছেন আর শিক্ষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

এসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব  মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকরা অযৌক্তিক আন্দোলন করছেন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। রাতারাতি সম্ভব নয়। জনবল কাঠামো অনুযায়ী তাদের এমপিওভুক্ত করাও সম্ভব নয়। মানবিক গ্রাউন্ড ছাড়া কোনও গ্রাউন্ড নেই।’

যদিও সিনিয়র সচিব এই কথা বললেও এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরকে শিক্ষকদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল কয়েক মাস আগে। ওই সময় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও কীভাবে তাদের ব্যবস্থা করা হবে তা জানানো হয়নি।’ আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুনির্দিষ্ট মতামত চেয়েছি। এরপর চলে গেছে কয়েক মাস। এ সময়ের মধ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের দুর্গম এলাকায় মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ এবং শিক্ষার্থীদের ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান ভীতি দূর করতে ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ)’ এর আওতায় দুই হাজার একশ’ প্রতিষ্ঠানে পাঁচ হাজার দুইশ অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক (এসিটি) নিয়োগ করে সরকার। শিক্ষার্থীদের ২০০৮ সালে চালু হওয়া প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে হলে এসব শিক্ষকরা পড়েন চাকরির অনিশ্চয়তায়।

প্রকল্পের আওতায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের নিয়োগপত্রে চাকরির বিষয়ে বলা ছিল— প্রকল্প সম্প্রসারণ করে অথবা এমপিওভুক্ত করে চাকরি অব্যাহত রাখা হবে। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের বিদ্যমান নীতিমালা এবং এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী এসব শিক্ষকদের নিয়োগের বিধান নেই। ফলে নিয়োগ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় এসব শিক্ষকরা বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে এমপিওভুক্তির। শিক্ষকরা বলছেন প্রকল্প প্রধান ও মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে ক্লাস চালিয়ে যান ভালো খবর আসবে। আমরা বিনা বেতনের ছাত্রদের পড়াচ্ছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

বাংলাদেশ এসিটি অ্যসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কৌশিক চন্দ্র বর্মণ জানান, সর্বশেষ তারা গত ৩ ফেব্রুয়ারিতে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষকরা। গত ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতীকী অনশন করেন তারা। এতেও সরকারের পক্ষে কোনও আশ্বাস না পেয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় অনশন কর্মসূচি শুরু করা হয়। বুধবারও (১৩ ফেব্রুয়ারি)  এ  কর্মসূচি চলছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই সংকট মেটাতে এবং শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সুপারিশ করা হয়েছিল। এই সুপারিশের পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) জাবেদ আহমেদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এসিটিদের স্থায়ী করার ব্যবস্থা নিতে গত ২৮ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশ তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, প্রকল্পের মেয়াদ শেষে এসব শিক্ষক বাদ পড়লে নির্বাচিত সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এসডিজি ফোর অর্জনে পিছিয়ে পড়তে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশ আরও বলা হয়, সেকায়েপ প্রকল্পে কর্মরত অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো এবং শিক্ষার অব্যাহত মানোন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকবেন এবং বেতনভাতা দিতে হবে।

অর্থ বিভাগে পাঠানো ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, আইনগত জটিলতার কারণে এসিটি শিক্ষকসহ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত রিসোর্স টিচারদেরও (আরটি) এমপিওভুক্ত করা সম্ভব নয়। এসব শিক্ষকদের ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি)’ প্রকল্পের আওতায় একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে নিয়োগ করার জন্য সুপারিশ করা হলো।

গত ২৮ অক্টোবর সরকারের আগের মেয়াদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন ‘যে কোনও উপায়ে তাদের স্থায়ী করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব শিক্ষকের জন্য নতুন কোনও পদ বের করে স্থায়ী করা হবে। কারণ তারা অনেক মেধাবী এবং ইতোমধ্যে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এদের বেশিরভাগেরই চাকরির বয়স চলে গেছে। প্রকল্পে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে বিদায় করে দেওয়া হয়, কিন্তু আমরা তা করবো না। তাদের স্থায়ী করার ব্যবস্থা নেবো।’

নতুন গঠিত সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসিটি শিক্ষকরা আমার সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। এটি অত্যন্ত সফল প্রকল্প। দক্ষ মানব সম্পদ কোনোভাবে যেন আমাদের হাতছাড়া না হয়, সে জন্য আমি প্রথমদিন থেকেই কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। যেন এই দক্ষ শিক্ষকরা কোনোভাবেই হাতছাড়া না হয়। তাদের আমাদের সঙ্গে রাখতে হবে। এই শিক্ষকরা যেখানে কাজ করেছেন সেখানে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। আমাকে ধারণা দেওয়া হয়েছে আরও একটি প্রকল্প তৈরি করে সেখানে তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার একটা পরিকল্পনা হয়েছে। এই বিশ্লেষণ আমি পেয়েছি। তাতে আমার মনে হয়েছে তাদের রাখতে পারবো।’

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!