X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডা. রাজনের মৃত্যুকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না সহকর্মীরা

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
১৮ মার্চ ২০১৯, ২১:২৬আপডেট : ১৮ মার্চ ২০১৯, ২১:২৯
image

ডা. রাজন কর্মকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাজন কর্মকারের (৪০) মৃত্যুতে তার সহকর্মীরা শোকস্তব্ধ। তাদের অনেকেই এই মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলে অভিযোগ করেছেন।  সোমবার (১৮ মার্চ) দুপুরে ডা. রাজন কর্মকারের মরদেহ বিএসএমএমইউতে নিয়ে আসলে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়াসহ অন্যরা ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তার শিক্ষক, সহকর্মী, শিক্ষার্থী ও বন্ধুরা মৃত্যুর সঠিক তথ্য উদ্ঘাটনের দাবি জানান।

গত শনিবার শেষ রাতে হঠাৎ করেই মারা যান ডা. রাজন। এই মৃত্যু অস্বাভাবিক বলে সন্দেহ করছেন তার স্বজন ও সতীর্থরা। তার স্ত্রী একই প্রতিষ্ঠানের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কৃষ্ণা রানী মজুমদার রুপা। ডা. কৃষ্ণার বাবা সরকারের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

এ প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজনকে তো আমরা সবাই চিনি। ভালো ছেলে, ভালো মানুষ। কারও প্রতি কোনও ক্ষোভ-অভিযোগ নিয়ে কখনও তিনি আসেননি। অনেকেই পারিবারিক অনেক অভিযোগ নিয়ে আসে, আমরা মিটিয়ে দিই। না পারলে আমরা আরও ওপর মহলে বিষয়টি পাঠাই। কিন্তু এরকম কিছু নিয়ে রাজন কোনওদিন আসেননি। তিনি খুব ভালো কাজ জানতেন।’

বিএসএমএমইউয়ের সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক ডা. আলী আসগর মোড়ল অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। কী ঘটেছে সেটি জানতে চাই। দোষীকে অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক, যেন তারা বিচার প্রক্রিয়ায় কোনও বাধা দিতে না পারে। রাজন অনেক ভালো মানের সার্জন ছিলেন। মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগটা তার অভাবে পঙ্গু হয়ে গেল।’

বিএসএমএমইউয়ের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুভাষ কান্তি দে অভিযোগ করে বলেন, ‘তার মৃত্যুর অস্বাভাবিকতা নিয়ে অভিযোগ করাটা যৌক্তিক। তার স্ত্রী একজন চিকিৎসক। যখন রাজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে তখন তিনি মারা গেছেন। তিনি ওই দিন ১২টা পর্যন্ত ওটি (অপারেশন থিয়েটার) করে গেছেন। হাসপাতালে যারা ছিলেন তারা বলেছেন, তার ন্যূনতম কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না। অল্প সময়ের মধ্যে এমন কী হলো যে তাকে নিয়ে মৃত অবস্থায় আসতে হলো। তার স্ত্রী ডাক্তার। তিনি লক্ষণ বোঝেন। এক্ষেত্রে আমরা আশা করি না, মৃতদেহ হাসপাতালে আসবে। আমরা আশা করেছি, তাকে আগেই হাসপাতালে আনা হবে। তার স্ত্রীর অ্যাটেম্পগুলো দেখে আমাদের মনে সন্দেহ জাগছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজন প্রমিনেন্ট সার্জনদের একজন। আমি আর তিনি কাছাকাছি ফেস আর ব্রেন নিয়ে কাজ করি। কাজের ক্ষেত্রে আমরা একে অপরের কাছে মতামত চাই। সেজন্য আমার সঙ্গে তিনি খুব রিলেটেড। আমরা দুজনেই চট্টগ্রাম মেডিক্যালের ছাত্র। তার এ মৃত্যু স্বাভাবিক হতে পারে, অস্বাভাবিকও হতে পারে। আমরা সুষ্ঠু তদন্ত চাই। অস্বাভাবিক হলে অবশ্যই বিচার হতে হবে।’

ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের রেসিডেন্ট ডা. বিকাশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘তিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন। পড়াশোনা, অপারেশন সবক্ষেত্রেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। বয়স কম, কিন্তু জানতেন অনেক। নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি ডিপার্টমেন্টে শনিবার ছিলেন। তার কার্ডিয়াক কোনও সমস্যা ছিল না। হঠাৎ করে মারা গেছেন। তাই মনে হচ্ছে, এটা অস্বাভাবিক মৃত্যু। এজন্য আমাদের দাবি ছিল, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হোক।’

আবাসিক চিকিৎসক লায়লা সিদ্দীকি বলেন, ‘স্যার খুব স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি ছিলেন। সব সময় হেসে হেসে কথা বলতেন। তিনি চাপে আছেন কিনা এটা কখনও বোঝা যেত না। তার মেজাজের জায়গায় কখনও ভেরিয়েশন ছিল না। তার চিন্তাভাবনা সব সময় ছিল পেশাকে নিয়ে। কীভাবে অন্য সবার সঙ্গে আমাদের ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি নিয়ে কাজ করবেন এটাই চাইতেন। অনেকে সার্জন হিসেবে পাস করে বের হন কিন্তু কাজ করেন না। কিন্তু স্যার পিওরলি ম্যাক্সিলোফেসিয়াল নিয়ে কাজ করতেন।’

রেসিডেন্ট ডা. আবদুর রহমান বিশ্বাস বলেন, ‘স্যার খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি ডেকে ডেকে সবাইকে শেখাতেন। একজন রাজন কর্মকারের মৃত্যু মানে দেশের একজন সেরা সার্জনের মৃত্যু। তিনি ছিলেন অনেকের প্রিয়। তিনি খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তিনি কখনই ব্যক্তিগত বিষয় আমাদের কাছে শেয়ার করতেন না। সবদিক দিয়ে স্যার খুব ভালো ছিলেন। স্যারের কোনও কার্ডিয়াক প্রবলেম ছিল না। তার এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। তার মৃত্যু স্বাভাবিক কিনা জানার জন্যই আমরা ময়নাতদন্তের দাবি জানিয়েছি। কেউ যদি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকেন তাহলে উপযুক্ত শাস্তি চাই। দেড় বছর আগে তাকে একবার শারীরিক আঘাত করা হয়েছে। সে সময় তার ব্রেন ইনজুরিও হয়েছিল। তাই আমাদের সন্দেহটা আরও বেশি।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি সকাল ৬টায় গিয়ে দেখি তখনও স্যারের লাশটা পড়ে ছিল। একজন মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু হলে কাছে অবশ্যই পরিবারের মানুষরা থাকতেন। এইরকম অনেক বিষয়ে আমাদের সন্দেহ বেড়েছে।’

শনিবার রাতে সর্বশেষ ওটিতে ডা. রাজনের সঙ্গে ছিলেন রেসিডেন্ট ডা. অর্ণব বড়ুয়া। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্যার আমার সঙ্গে বিকাল ৪টা থেকে ওটি করেছেন। আমরা মেইন অংশটায় দুই-তিন ভাগে কাজ করেছি। আমাদের কাজটা ৯টার দিকে শেষ হয়। বাকি কাজটা সাড়ে ১১টার দিকে শেষ হয়। এরপর আমরা কথা বলি, খাবার খাই। তখন তার মধ্যে কোনওরকম সমস্যা দেখিনি। তাকে হাসিখুশি মনে হয়েছে। তিনি যাওয়ার সময়ও হেলদি ছিলেন। স্যার ফ্যামিলির ব্যাপারে খুবই কনজারভেটিভ ছিলেন। অন্য সব বিষয়ে আলোচনা হতো, এ ব্যাপারে কিছু বলতেন না।

‘আমি ১২টা পর্যন্ত ছিলাম। তার ঘটনাটা ঘটেছে রাতে। তাই আমার পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না কী হয়েছে। তার প্রেসারের প্রবলেম ছিল, কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল।’

ডা. রুম্মন তার মৃত্যুকে অস্বাভাবিক হিসেবে অভিযোগ করে বলেন, ‘এই মৃত্যু স্বাভাবিক না। আমরা তার মৃত্যুর আসল কারণটা জানতে চাই। আমরা আরও বেশি এই কারণে সন্দেহ করছি যে,  তিনি এর আগে ফিজিক্যাল অ্যাসাল্টের শিকার হয়েছিলেন। তাকে পপুলারে ভর্তি থাকতে হয়েছিল। তখন তাকে দুটো হাসপাতালে রাখা হয়। তখন তার কাছে কাউকে যেতে দেওয়া হয়নি। এ সময় তিনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন।’

তার শিক্ষার্থী রেসিডেন্ট ডা. কানিজ ফাতিমা বলেন, ‘রাজন স্যারের মৃত্যুতে দেশ একজন সেরা সার্জনকে হারাল। তার মতো সার্জন অনেক কম আছেন। তার মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এই ক্ষতি আমাদের জন্য অপূরণীয়। স্যার কাজপাগল, পড়াপাগল মানুষ ছিলেন।’

রাজনের সহকর্মী ডা. গালিব বলেন,  ‘এমন রাজন যুগে যুগে আসে। আবার কতদিন পরে আসবে সেটা আমরা বলতে পারি না। আমার মনে হয়, এতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।’

গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফওজিয়া হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজন ও তার স্ত্রী দুজনেই আমার খুব কাছের। তাদের দুজনের দাম্পত্যজীবন খুব ভালো ছিল। বাইরে যা শোনা যাচ্ছে তা সত্যি নয়। দাম্পত্য কলহ কার নেই? সবারই আছে। একটা মানুষের মৃত্যুর পর এভাবে কাউকে অপবাদ দেওয়া ঠিক নয়। দুজনেই খুবই ভালো। খুবই ব্রিলিয়্যান্ট একটা রাইজিং কাপল ছিল।’

এ সময় চিকিৎসকরা রাজন হত্যার বিচার চাই স্লোগান দেন এবং বটতলা চত্বরে মিছিল করেন। তারা আগামীকাল বেলা ১২টায় এ ব্যাপারে একটি মানববন্ধন করবেন।

ইতোমধ্যে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুর গ্রামের বাড়িতে ডা. রাজনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার মা খুকুরানী কর্মকার ও বাবা সুনীল কর্মকারের তিনি প্রথম সন্তান। তারা দুই ভাই, এক বোন।

/টিওয়াই/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী