X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষক নিয়োগে জালিয়াতি ধরা পড়ে এমপিওভুক্তির পর

এস এম আববাস
২১ মার্চ ২০১৯, ০৭:৫২আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৯, ০৭:৫২

মাউশি দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) নিয়োগ জালিয়াতি কিছুতেই থামছে না। বিদ্যমান নিয়মের ফাঁক-ফোকর দিয়ে একের পর এক  শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ। রহস্যজনক কারণে নিয়োগের সময় এই জালিয়াতি ধরা পড়ছে না। এমপিওভুক্তির পর ঠিকই তা ধরা পড়ে। অভিযোগ আছে, যারা এই জালিয়াতির জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে ক্ষতির শিকার হন কেবল শিক্ষক-কর্মচারীরাই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, নাটোরের সিংড়া উপজেলার আলহাজ জালাল উদ্দিন কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ সাতজন শিক্ষককে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয় ম্যানেজিং কমিটি। তদন্তে জালিয়াতির ঘটনা প্রমাণিত হলে গত ৩১ ডিসেম্বর সাময়িকভাবে ওই সাত শিক্ষকের বেতন বন্ধের নির্দেশসহ শোকজ করা হয়। কেন স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠানটির এমপিও বন্ধ করে দেওয়া হবে না— তা জানতে চেয়ে সাত দিনের সময় দেয় মাউশি। এরপর গত ৯ জানুয়ারি স্থায়ীভাবে বেতন বন্ধ করে তাদের উত্তোলিত বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেয় মাউশি। কিন্তু এই জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মাউশির আদেশেও এ নিয়ে কিছু বলা হয়নি।

ওই আদেশে স্বাক্ষরকারী মাউশির শিক্ষা অফিসার চন্দ্র শেখর হালদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডকে আলাদা করে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

মাউশি সূত্রের দাবি, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে এমন অনেক জালিয়াতি ঘটনা ধরা পড়ে। অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের কাছে এমপিও’র টাকা ফেরতও চাওয়া হয়। কিন্তু, টাকা ফেরত পাওয়ার নজির নেই বললেই চলে।

সূত্রমতে, আলহাজ জালাল উদ্দিন কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। বিষয়টি স্বীকার করে শিক্ষা অফিসার চন্দ্র শেখর হালদার জানান, এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা অনেক রয়েছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে উত্তোলিত বেতন-ভাতা ফেরত চেয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটির দুর্নীতির কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে।’

এমপিওভুক্তির সময় কেন ধরা পড়ে না, পরে কেন ধরা পড়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিয়োগের সময় জালিয়াতি করাই হয় আর্থিকসহ অন্যান্য দুর্নীতির কারণে। একইভাবে এমপিও দেওয়ার সময়ও জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয় একই কারণে। সে কারণে তখন ধরা পড়ার প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু পরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত হলে বেরিয়ে পড়ে। তবে আগে দুর্নীতির সুযোগ থাকলেও এখন তা হচ্ছে না। আমরা কঠোর অবস্থানে থাকার কারণে এখন আগের দুর্নীতিও ধরা পড়ছে।’

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ জালিয়াতির অনেক ঘটনা ধরা পড়ায় বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হলেও থেমে নেই জালিয়াত চক্র। তারা নতুন নতুন উপায়ে ভুয়া নিয়োগ দিয়েই যাচ্ছে। ম্যানেজিং কমিটির সহায়তায় পাবনার চাটমোহর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ভুয়া পাঠ্য বিষয় দেখিয়ে নিজের স্ত্রীকে সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৬ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাউশির মহাপরিচালককে এই ভুয়া নিয়োগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এদিকে, গাইবান্ধার সাদুল্লাহপুর উপজেলার দক্ষিণ হাটবমুনী এনআই  দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক সাইদুর রহমানের জাল সনদ ধরা পড়েছে। এ কারণে চাকরিকালীন সময়ে তিনি বেতন-ভাতা বাবদ যে পরিমাণ টাকা উত্তোলন করেছেন, তা ফেরত আনার বিষয়ে মাউশিকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অধিদফতরের মহাপরিচালকের বরাবর গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি জারি করা আদেশে বলা হয়, ‘এনআই  দাখিল মাদ্রাসার কবে এমপিও হয়েছে, ওই শিক্ষক কত টাকা  উত্তোলন করেছেন, তা দ্রুত জানাতে হবে।’

পাবনার সাথিয়া উপজেলার দেবীপুর তেবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের বাংলা ও হিসাব বিজ্ঞানের দুই প্রভাষককে জালিয়াতি করে নিয়োগ দেয় ম্যানেজিং কমিটি। এই অভিযোগে গত ১৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয় মাউশি।

অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এসব নিয়োগ জালিয়াতির সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ যেমন জড়িত থাকে, তেমনই এসব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি করার ক্ষেত্রে অধিদফতরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। অভিযোগ আছে, তারা অর্থের বিনিময়ে একাজ করেন।   

নিয়োগ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না প্রশ্নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) জাবেদ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্নীতি,স্বেচ্ছাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে। সে কারণেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি  গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির ক্ষমতা অনেক। প্রতিষ্ঠান প্রধানের জবাবদিহিতা ম্যানেজিং কমিটির হাতে। সে কারণে খুব সহজে কিছু করার থাকে না। পুরনো আইন ও নীতিমালা সংশোধন করা প্রয়োজন। তাহলে দুর্নীতির প্রবণতা কমে আসবে।’

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদ্যমান নিয়মে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার শিক্ষা বোর্ডের। আমরা শিক্ষা বোর্ডকে সুপারিশ করে থাকি, তারা ব্যবস্থা নেয়। তবে বিদ্যমান আইন সংশোধন করলে দুর্নীতি কমবে। আমি মনে করি, বিদ্যামান আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।’

বিদ্যমান আইনে ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা হলো কমিটি ভেঙে দেওয়া। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই বলে জানান ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়াউল হক। তিনি বলেন, ‘আমাদের যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমাদের হাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা হচ্ছে ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে দেওয়া। এছাড়া, যদি কেউ যদি দুর্নীতি করে তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’

মাউশি সূত্র বলছে, ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে দেওয়া ছাড়া এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষা বোর্ডের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে প্রচলিত আইনে মাউশি বা শিক্ষা বোর্ড ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাউশি বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড প্রচলিত আইনে এ পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা—  এমন কোনও উদাহরণ নেই।

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘গাজার গণকবরে অন্তত ২০ জনকে জীবন্ত দাফন’
‘গাজার গণকবরে অন্তত ২০ জনকে জীবন্ত দাফন’
‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে’
‘বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে’
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
প্রতি শ্রেণিতে ৫৫ শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর
উত্তাল চুয়েট, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
উত্তাল চুয়েট, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা