X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশে রেশনের চাল নিয়ে যত অভিযোগ

জামাল উদ্দিন
১৬ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:৪১আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ১৭:২৬

পুলিশের সমস্যা: এক

রেশন নিয়ে একসময় বিস্তর অভিযোগ ছিল পুলিশ সদস্যদের। গত কয়েক বছরে পুলিশের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, এর মধ্যে রেশন সুবিধাও রয়েছে। রেশন পণ্যের মধ্যে রয়েছে— চাল, ডাল, আটা, চিনি ও ভোজ্য তেল। এই পাঁচ পণ্যের মধ্যে চারটি নিয়ে কোনও অভিযোগ না থাকলেও চাল নিয়ে পুলিশ সদস্যদের আছে অসন্তুষ্টি। গন্ধযুক্ত ও নিম্নমানের রেশনের চাল নিয়ে তারা ক্ষুব্ধ।

পুলিশ সদস্যরা বলছেন, মোটা হলেও সমস্যা নেই, কিন্তু চালটা যেন ভালো হয়। রেশন নিয়ে আরেকটু বাড়তি সুবিধার দাবি আছে তাদের— আজীবন যেন রেশনের সুবিধা দেওয়া হয়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে (কল্যাণ সভায়) সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ দাবি জানিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় রাখবেন বলে তাৎক্ষণিক আশ্বাস দিয়েছেন।

পুলিশ সদর দফতরের সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রেশন নীতিমালায় সংশোধন করা হয়। পুলিশে কর্মরত এবং প্রেষণে নিয়োজিত সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে এই নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৯ সালের মার্চে এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়া হয়। ওই বছরের ১ মার্চ ইস্যু করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক পত্রে বলা হয়, পুলিশের নন গেজেটেড সদস্যদের বিদ্যমান রেশন বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত সংশোধিত ‘রেশন নীতিমালা-২০০৮’ অনুযায়ী অর্থ বিভাগ সম্মতি দিয়েছে। এরপরই সরকারের নির্ধারিত মূল্যে রেশন নীতিমালা কার্যকর করা হয়, যা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেশন হিসেবে যা দেওয়া হয়

নিয়মানুযায়ী পুলিশের (কর্মকর্তা-কর্মচারী) প্রতিটি পরিবারের চারজন সদস্য রেশন পাবেন। পরিবার এক সদস্যের হলে তিনি প্রতিমাসে ১১ কেজি চাল (সিদ্ধ বা আতপ), আটা ১২ কেজি, চিনি এক কেজি ৭৫০ গ্রাম, আড়াই লিটার ভোজ্য তেল, সাড়ে তিন কেজি ডাল ও ৩৭ কেজি ৩২৪ গ্রাম জ্বালানি কাঠ পাবেন। দুই সদস্যের পরিবার হলে মাসে ২০ কেজি চাল, ২০ কেজি আটা, তিন কেজি চিনি, সাড়ে চার লিটার ভোজ্য তেল, সাড়ে পাঁচ কেজি ডাল পাবেন। তিন সদস্যের পরিবার হলে মাসে ৩০ কেজি চাল, ২৫ কেজি আটা, চার কেজি চিনি, ছয় লিটার ভোজ্য তেল ও সাত কেজি ডাল পাবেন। আর চার সদস্যের পরিবার পাবে প্রতিমাসে ৩৫ কেজি চাল, ৩০ কেজি আটা, পাঁচ কেজি চিনি, আট লিটার ভোজ্য তেল ও আট কেজি ডাল। উল্লেখ্য, জ্বালানি কাঠ পাবেন শুধুমাত্র নন গেজেটেড পুলিশ সদস্য এবং পুলিশ ইউনিটে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোনও পুলিশ সদস্য যদি মারা যান, তবে স্বাভাবিক অবস্থায় চাকরি থেকে তার অবসর গ্রহণের যে মেয়াদ (পিআরএলসহ), সেই পর্যন্ত সর্বাধিক তিন সদস্যের পরিবারকে রেশন সুবিধা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।

যেভাবে রেশন দেওয়া হয়

যারা রেশন পাবেন তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিজ নিজ নামে রেশন কার্ড ইস্যু করাবেন। এরপর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য নির্ধারিত হারে রেশন তুলতে পারবেন। প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের কর্মরত জেলা ও ইউনিট ছাড়াও অন্য যেকোনও জেলা ও ইউনিট থেকে রেশন তুলতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে বিষয়টি নিজ নিজ ইউনিট প্রধানকে কমপক্ষে ৩০ দিন আগে অবহিত করতে হবে। ইউনিট প্রধানকে আবার বিষয়টি পুলিশ সদর দফতরকে অবহিত করতে হবে। শান্তিরক্ষা মিশনে প্রেষণে, বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বা অন্য কোনও সরকারি কাজে বিদেশে দায়িত্ব পালনের সময় একই নিয়মে রেশন তুলতে পারবেন।

যেসব শর্ত অনুসরণ করা হয়

প্রতিটি পুলিশ পরিবারের সর্বাধিক দু’জন সন্তান রেশন পাওয়ার যোগ্য এবং সন্তানদের অনধিক ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত রেশন দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়সীমার আগে যদি কোনও সন্তান বিয়ে করেন এবং অর্থ উপার্জনে সক্ষম হন, তাহলে ওই সন্তানকে আর রেশন দেওয়া হয় না। তবে শারীরিকভাবে অসমর্থ, পঙ্গু অথবা বিকলাঙ্গ সন্তান যদি বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে যতদিন তিনি নির্ভরশীল থাকবেন, ততদিন রেশন পাবেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত থাকলে তাদের যেকোনও একজন রেশন সুবিধা পাবেন। অন্যজন পরিবারের সদস্য হিসেবে রেশন পাবেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই যদি ভিন্ন ভিন্ন রেশন সুবিধা সম্বলিত সংস্থায় কর্মরত থাকেন, তাহলে উভয়ের যেকোনও একজন তার নিজ সংস্থা থেকে রেশন উত্তোলন করতে পারবেন এবং অন্যজন পরিবারের সদস্য হিসেবে রেশন পাবেন। এলপিআর-এ (পিআরএল) থাকার সময়ে প্রত্যেক সদস্য একইহারে রেশন পাবেন। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সদস্য নিজের এবং পরিবারের জন্য রেশন পাবেন। প্রসঙ্গত, বিশেষ দিনগুলোতে প্রীতিভোজ উপলক্ষে পুলিশ সদস্যদের পোলাউর চাল দেওয়া হয়।

রেশনের চাল নিয়ে অভিযোগ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দফতরের একাধিক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশের প্রত্যেক সদস্যকে যে পরিমাণে রেশন দেওয়া হয়, তা একজন সদস্যের জন্য পর্যাপ্ত। রেশন হিসেবে দেওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে চাল ছাড়া সব উপকরণই ভালো। ডাল, আটা, চিনি ও ভোজ্য তেল নিয়ে কারও কোনও অভিযোগ নেই। তবে যে চাল দেওয়া হয় সেটা অত্যন্ত নিম্নমানের। অনেক দিনের পুরনো চালে ইটের টুকরা ও পাথর থাকে। চালগুলোও থাকে ভাঙা। রেশনের চালের মানটা বাড়ানো গেলে ও খাবার উপযোগী চাল সরবরাহ করা হলে সরকার যে উদ্দেশ্যে পুলিশ সদস্যদের রেশন সরবরাহ করছে, সেই উদ্দেশ্যটা সফল হতো। পুলিশ সদস্যরাও রেশনের চাল নিয়ে খেতে পারবেন। সাধারণত দেখা যায়, নিম্নমানের হওয়ায় চাল তোলার পর বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য খুব কম দামে তা বিক্রি করে দেন। এটা কারও প্রত্যাশিত নয়। খাওয়ার উপযোগী রেশনের চাল সরবরাহ করা জরুরি।

পুলিশ সদর দফতরের লজিস্টিক শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘জেলা খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে আমরা অনেকবার দেনদরবার করেছি। প্রত্যেকটা জেলার পুলিশের পক্ষ থেকেই এটা করি। তাদেরও কিছু নিয়ম আছে। তারা বলেছেন, এ বছরের চালটা আগামী বছরের জন্য মজুত রাখা হয়। সুতরাং এ বছর দেবে বিগত বছরের চাল। ফলে আগের মজুত করা চাল বেশিরভাগই নষ্ট থাকে। সেটা তারাও জানেন। এখন সরকার যদি নষ্ট চাল দেয়, তাহলে আমরা না খেয়ে কী করবো।’

রেশনের চাল নিয়ে পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে নেতিবাচক মতামত পেয়ে দুই বছর আগে নিজেরাই চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুলিশের সদর দফতর। এ বিষয়ে প্রস্তাব দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দফতরকে চিঠিও পাঠানো হয়। কিন্তু সেই প্রস্তাবনা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ফলে সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে সরবরাহ করা চালই তাদের নিতে হচ্ছে।

রেশন নিয়ে কথা হয় রিজার্ভ পুলিশের কনস্টেবল ছাব্বিরের সঙ্গে। তিনি জানান, রেশনের পরিমাণ ও পণ্যের মান নিয়ে তার কোনও অভিযোগ নেই। ছাব্বির বলেন, ‘রেশনের মান খারাপ না। শুধু চালটাই সমস্যা। মোটা হলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু খাদ্য গুদাম থেকে আসা চালটা প্রায়ই নিম্নমানের হয়। এছাড়া, তেল, চিনি, আটা ও ডাল খুবই ভালো। কর্মকর্তারা যে মানের রেশন পণ্য পেয়ে থাকেন, আমরাও একই মানের রেশন পণ্য পেয়ে থাকি।’

রেশন নিয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্য রায়হানেরও একই বক্তব্য। রেশনের চালের মান ভালো না বলে জানান তিনি।

ইন্সপেক্টর আবদুল হালিম বলেন, ‘রেশন নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তবে চালটা খাওয়া যায় না। তাই রেশন তোলার পর খুব অল্প দামে চালটা বিক্রি করে দিতে হয়।’

রেশনের পণ্যের মান নিয়ে কথা হয় পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (লজিস্টিক) মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বেশি কিছু বলতে চাননি। শুধু বলেন, ‘পুলিশের সক্ষমতা ও আধুনিকায়ন হচ্ছে। আগের চেয়ে রেশনও অনেক ভালো হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে।’

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (প্রশাসন) মিলন মাহমুদ বলেন, ‘চালের বিষয়টা হচ্ছে— সরকারি গুদাম থেকে নিতে হয়। তারা চালটা হয়তো আজ কিনে রাখলো, সেটা হয়তো আগামী এক থেকে দু’বছরের মধ্যে খেয়ে শেষ করতে হবে। এ বছর যেটা সংগ্রহ করলো, সেটা রেখে দিয়ে গত বছরেরটা রেশন হিসেবে দেওয়া হয়। ওটা তো আমরা কিনতে পারি না। আমরা যে অংশটা কিনতে পারি, যেমন— ডাল, তেল, চিনি ও আটা। সেগুলো আমরা সর্বোচ্চ মানেরটাই কিনে থাকি।’

/এপিএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা