X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি প্রতিদিন তাড়া করে বেড়াতো উদ্ধারকর্মী হিমুকে

নুরুজ্জামান লাবু ও নাদিম হোসেন
২৬ এপ্রিল ২০১৯, ০০:৩১আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ১৮:০৭

হিমু

রানা প্লাজা ধসের পর নিজের হাতে অনেকের হাত-পা কেটে উদ্ধার করেছিলেন নওশাদ হাসান হিমু ওরফে হিমু হিমালয়। ঘটনার শুরুর দিন থেকে প্রায় পনের দিন দিনরাত ছিলেন সেখানেই। আটকে পড়া শ্রমিকদের করাত দিয়ে হাত-পা কেটে উদ্ধার করেছেন। পরবর্তীতে আরও টানা ১৭ দিন কাটিয়েছেন হাসপাতালে। নিজের উদ্যোগেই সেবা-শুশ্রুষা করেছেন পঙ্গু রোগীদের। এরপর থেকেই চোখের সামনে ভয়াবহ সেসব স্মৃতি মানসপটে ভেসে আসতো তার। রক্ত বা কাঁচা মাংস দেখতে পারতেন না। রানা প্লাজার সেইসব দুঃসহ স্মৃতি প্রতিদিন তাড়া করে বেড়াতো তাকে। মাঝে মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণও করতেন। নিজের জীবন আর দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও হতাশ করে তুলেছিল তাকে। তাই  গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার দুর্ঘটনার ষষ্ঠ বার্ষিকীতে  নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারের বিরুলিয়া সাদুল্যাপুর গ্রামে একা জীবনযাপন করা হিমু বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাসার সামনে নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পরবর্তীতে তার চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে গিয়ে আগুন নেভালেও ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক এই সাংগঠনিক সম্পাদকের। খবর পেয়ে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে। বৃহস্পতিবার সেখানে স্বজন, বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা ছুটে যান মর্গে।

নিহতের মা আফরোজা বেগম জানান, ২০১৩ সালে তারা ঢাকার শ্যামলী এলাকায় থাকতেন। রানা প্লাজা ভবন ধসের খবর পেয়ে আহত শ্রমিকদের রক্ত দেওয়ার জন্য হিমু তার মাকে সঙ্গে নিয়ে সাভারের রানা প্লাজায় যান। তবে ভেতরে অনেক শ্রমিককে আটকে পড়তে দেখে অন্যদের সাঙ্গে শুরু করে দেন উদ্ধার কাজ। ভবন ধসের উদ্ধার কাজ সমাপ্ত হওয়ার দিন পর্যন্ত তিনি রানা প্লাজায় কাজ করেছেন। এরপর সাভারের গণ্যস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালসহ বিভিন্ন  হাসপাতালে ভর্তি রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের সেবা করে সময় কাটাতেন। রানা প্লাজার নিহত ও আহত শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গেও তার গড়ে উঠে সখ্যতা। অনেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।

আফরোজা বেগম আরও জানান, রানা প্লাজার পর প্রায় সময়ই হিমু পরিবারের সকলের সঙ্গে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া জীবিত ও মৃত মানুষদের কীভাবে উদ্ধার করেছেন এসব বিষয়ে বলতেন। এছাড়াও তার ছেলের ভেতরে যে কোনও বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ খুব বেশি ছিল। যে কোনও বিষয় তার মাথাই একবার আসলেই সেই বিষয় নিয়ে সে খুব বেশি চিন্তা করতেন।

হিমুর বড় বোন নওশিন আফরোজ হিয়া বলেন, ‘সে ছোটবেলা থেকে মানুষের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতো। এসব করতে করতেই সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমি তাকে একাধিকবার কাউন্সেলিং করার জন্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবার কথা বলেছি। কিন্তু ও যেতে চায়নি। আমাদের আসলে জোর করে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ডিপ্রেশন তাকে শেষ করে দিল।’

হিমুর পরিবার

ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও বলা হয়, ‘রানা প্লাজা ধস হলে ছাত্র ফেডারেশনের উদ্ধার টিমের সবচেয়ে সাহসী ও পরিশ্রমী কর্মী হিসেবে উদ্ধার কাজ করেছে হিমু। রানা প্লাজায় চাপা পড়া মানুষের হাত-পা করাত দিয়ে কেটে বের করার কাজের যে অসহনীয় অভিজ্ঞতা তা প্রায়শই তাকে ঘুমাতে দিতো না। বিভিন্ন সময় সে বলতো মানুষের রক্তাক্ত শরীরের কাটা টুকরোগুলো ঘুমের ভেতর হাজির হয়। এই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিদিন পীড়া দিত, তাড়া করে বেড়াত।

রানা প্লাজার উদ্ধারকর্মী হিসেবে কাজ করার সময়ের সহযোগী এম এইচ শরীফ অঙ্ক জানান, তারা ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষে একসঙ্গে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন। হিমু আটকে পড়া অনেক লোকজনকে উদ্ধার করেছে। রানাপ্লাজার আটকে পড়া মানুষের বীভৎস মৃত্যু হিমু কাছ থেকে দেখেছে। এসব তার মনে অনেক বেশি দাগ কেটেছিল। রানা প্লাজা ছাড়াও তুবা গার্মেন্টে আগুন লাগার পর সেখানে গিয়ে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো ও প্রতিবাদে শামিল হয়েছিল সে। এর আগে গণজাগরণ মঞ্চেরও সক্রিয় কর্মী ছিল। সুন্দরবন মুভমেন্টেও ছিল। রানা প্লাজার শকড ও অন্যান্য হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল সে।

হিমুর আরেক সহযোগী উদ্ধারকর্মী ও রাজনৈতিক সহকর্মী এম এইচ রিয়াদ বলেন, ‘আমরা এক সঙ্গে উদ্ধারকাজে ছিলাম। ও অনেক মানুষের হাত-পা কেটে উদ্ধার করেছে। এরপর থেকে ও রক্ত এবং কাঁচা মাংস দেখতে পারতো না। মাস দুয়েক আগেও এক বন্ধুর বাসায় ও মুরগি কাটতে দেখে চিৎকার করে ওঠে। ও আসলে ট্রমাটাইজ হয়ে গিয়েছিল অনেক বেশি। এছাড়া ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনেক কারণও রয়েছে ওর মৃত্যুর পেছনে।’

পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বরিশালের এ কে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে হিমু। এরপর আইন বিভাগে আশা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু পড়াশুনা শেষ করতে পারেনি। কুকুর-বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল তার। কুকুরপ্রেমী ছিল বেশি। ডগ ট্রেইনার হিসেবেও কাজ করতেন। এজন্য চীনে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিল।

হিমুর এমন অকাল মৃত্যুর খবর শুনে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে শেষ বিদায় জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের অনেক নেতাকর্মী। গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভা প্রধান ও গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য তাসলিমা আক্তার লিমা বলেন, ‘হিমু কিছুটা ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিল। ডিপ্রেশনে ভুগছিল। আমরা তাকে গণস্বাস্থ্যর কর্মশালায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তাকে দিয়ে এসব বিষয় লিখিয়েছি, যেন তার ভেতরে এসব দুঃসহ স্মৃতিগুলো গুমোট হয়ে না থেকে বের হয়ে আসে। ওকে আমরা ইজি করতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু এসব নিয়ে ও অনেক বেশি ভাবতো। দুঃসহ স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে এসেছে তার কাছে।’

হিমুর আত্মাহুতির খবরে মর্গে ছুটে আসা গনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘ওর সঙ্গে আমাদের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে রানা প্লাজার ঘটনায় ছাত্র ফেডারেশনের ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। এছাড়া ২০১৫ এর নির্বাচনেও আমার সঙ্গে ছিল। পরের বছর থেকে সে একটু ইনঅ্যাকটিভ ছিল। শুনেছিলাম যে সে কিছুটা বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল।’

জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘দেখেন, রানা প্লাজার ওই ঘটনা ছাড়াও ও আসলে হতাশ হয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিকভাবে যে বদলের স্বপ্ন সে দেখেছে, সেটা হচ্ছে না। দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা দেখে হতাশ হয়েছিল। ব্যক্তি জীবনেও হতাশা ছিল। আসলে বদল বা পরিবর্তন তো একদিনে আসে না। এটা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ। ও হয়তো ওইভাবে চিন্তা করতে পারেনি। এসবের সঙ্গে রানা প্লাজার ঘটনাটা তার মনে আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল।’

নিহত হিমুর চাচা আরশাদ আলী জানান, হিমুর বাবা আবুল হাসান কয়েক বছর আগে মারা যান। ওর মা পটুয়াখালীর কলেজ রোডে থাকেন। দাদার বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। ও ছোট থাকতেই কিছুটা অন্য ধাঁচের ছিল। সহজ-সরল চিন্তার মধ্যে ছিল না। এজন্যই ও আরও বেশি ডিপ্রেশনে চলে যায়।

হিমুর মা আফরোজা বেগম জানান, বিরুলিয়ায় তাদের একটি জমি রয়েছে। ওই জমিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য ২৫ দিন আগে সেখানে যায় হিমু। এরপর এই জমির পাশে আব্দুল হক নামে এক ব্যক্তির একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে ছিল হিমু। ওখানেই সে একাই থাকতে শুরু করে। তিনি জানান, বুধবার সকাল থেকে একাধিকবার হিমু তাকে ফোন দিয়েছেন। তার অতিরিক্ত কল দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনিও দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। এমনকি মারা যাওয়ার কয়েক মিনিট আগেও হিমুর সঙ্গে তার কথা হয়। ওই সময় তিনি হিমুর কথাতেও ভিন্ন আচরণ বুঝতে পারেন। কিন্তু এর কিছু সময় পরই তার আত্মহত্যার খবর পেয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসে এক হাজারেরও বেশি গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত হয়। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ মানুষও ভবনের নিচে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধারে অংশ নেয়। একাধিক দিন আটকে পড়া শ্রমিকদের অনেককেই হাত-পা কেটে উদ্ধার করা হয়। এই উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া অনেক উদ্ধারকর্মীরাই পরবর্তীতে মানসিক ভারসাম্যহীন বা ট্রমাটাইজড হয়ে যান। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এসব উদ্ধারকর্মীদের কোনও মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

কথাসাহিত্যিক, মনোচিকিৎসক ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, রানা প্লাজায় সে মানুষের যে কষ্ট দেখেছে, নিজেও ট্রমাটাইজ হয়েছে। আমরা দেখেছি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের সঙ্গে ডিপ্রেশন ইজ ভেরি মাচ কমন। কোনও একটা দৃশ্য দেখে তার মাথায় গেড়ে বসেছে, সেটা তার মাঝে মাঝে মনে হয়। এর কারণে তার অন্তর্দহন হয়। সে কারণে সে ডিপ্রেশনে যেতে পারে। এছাড়া আরও অন্যান্য নানা কারণে ডিপ্রেশন হতে পারে। ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণে তার ডিপ্রেশন হতে পারে। একজন মানুষ মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারে থাকলে তখনই কেবল আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।

তিনি বলেন, ট্রমা থেকে সে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে বন্ধু ও স্বজনদের সচেতন হতে হবে। এরকম কারও ক্ষেত্রে ঘটলে তাকে দ্রুত সাইকিয়াট্রিকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসার মাধ্যমে তার ট্রমা বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস থেকে ভালো করা যায়। এটা করলে হয়তো সে বেঁচে যেত, তাকে আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত পরিণতিতে যেতে হতো না।


 

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!