রাজধানী উত্তরার জসিমউদ্দিন রোডের একটি বাসায় দুই গৃহকর্মীর নিহতের ঘটনার দুই দিন পার হলেও মৃত্যুর প্রকৃত কোনও কারণ এখনও জানাতে পারেনি পুলিশ। কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে সেটি এখনও রহস্যের অন্তরালেই থেকে গেছে। পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুই বলা যাবে না। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) রাতে দুই গৃহকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যৃ হয়।
পুলিশ জানায়, দুই গৃহকর্মী ছয়তলার বাসা থেকে পাশের একতলা ভবনের ছাদে কীভাবে গেলো, তা জানা যায়নি। ছয়তলা থেকে তারা লাফিয়ে পড়েছিল, নাকি তাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিল তাও জানা যায়নি।
উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতেই নিহত এক গৃহকর্মী হালিমার মা খাদিজা বেগম বাদী হয়ে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেলে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে বলা যাবে।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের জসিমউদ্দিন সড়কের একটি বাসায় এই ঘটনা ঘটে। নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পাঠায় পুলিশ।
নিহত দুই গৃহকর্মী হলো- হালিমা (১৪) ও রুবি (১৭)। তারা দু’জনই উত্তরার জসিমউদ্দিন সড়কের ৪০ নম্বর বাড়ির ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলার মালিক শিল্পপতি আব্দুল মাজেদের বাসায় কাজ করতো। গৃহকর্মী রুবি লক্ষ্মীপুরের কড়ই তলা গ্রামের এবং হালিমা গাজীপুরের কোনাবাড়ির আমবাগান এলাকার বাসিন্দা।
উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ জানায়, উত্তরার জসিমউদ্দিন সড়কের ৪০ নম্বর বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই দিন রাত ৩টা ৩২ মিনিটে পাঁচতলার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দুই গৃহকর্মী সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির ছাদে যায়। দরজা খোলার পর একজন তার স্যান্ডেল হাতে নেয়। দু’জনের কাঁধেই দুটি স্কুল ব্যাগ ছিল। তবে ছাদের কোনও ফুটেজ ওই সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখা যায়নি। এই সময়ের আগে ও পড়ে ওই বাড়ির কোনও লোককেও উপরে উঠতে বা নামতে দেখা যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও উত্তরা পশ্চিম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুকান্ত শাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই গৃহকর্মীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। দুটি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের সঙ্গে থাকা দুটি ব্যাগ থেকে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ও কাপড় পাওয়া গেছে। ধারণা করছি, দুই গৃহকর্মী ওই বাসা থেকে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা চুরি করে ছাদ থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল। হয়তো নামতে গিয়ে ছয়তলা ভবন থেকে পড়ে যেতে পারে। তবে সেটিও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দুই গৃহকর্মীর সঙ্গে থাকা দুটি স্কুল ব্যাগের একটির মধ্যে তাদের কাপড় ছিল এবং অপরটিতে তিন ভড়ি ওজনের একটি স্বর্ণের চেইন ও কয়েকটি স্বর্ণের রিং এবং নগদ আট হাজার টাকা ছিল। সেগুলো বর্তমানে থানা হেফাজতে রয়েছে।’
মামলার বাদী গৃহকর্মী হালিমার মা খাদিজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার মেয়ে ৪/৫ দিন পরপর আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতো। কোনও সমস্যার কথা কখনও বলে নাই। এখন মেয়ে মারা গেছে, কী আর করবো, আমাদের কোনও দাবি দাওয়া নাই। আমার মেয়ে যদি নিজে নিজেই বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে তবে কিছু করার নাই, আর যদি কেউ তাকে খুন করে তবে তার বিচার চাই।’
এদিকে, নিহত অপর গৃহকর্মী রুবির চাচাতো ভাই বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা খবর পেয়ে থানায় গিয়েছিলাম। ঘটনা শুনেছি, অনেক আলোচনা হয়েছে। রুবির মায়ের এই বিষয়ে কোনও দাবি-দাওয়া করেনি।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের কোনও দাবি ছিল না তাই দুই পক্ষের মধ্যে বিষয়টি আপস হয়েছে। লাশ নেওয়ার সময় আমরা ওই আপস নামায় স্বাক্ষর দিয়ে লাশ নিয়ে গেছি। মালিক রুবির পরিবারকে কিছু আর্থিক সহযোগিতার কথা বলেছে।’
শিল্পপতি আব্দুল মাজেদের ভাগিনা জামিউল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই গৃহকর্মীর মধ্যে রুবি প্রায় তিন এবং হালিমা দুই বছর ধরে এই বাসায় কাজ করছিল। পরিবারের সদস্যদের মতোই ওরা এই বাসায় থাকতো। কিন্তু কেন ওরা এইভাবে পালাতে গেলো সেটি জানি না। ওরা দুইজনই বাসা থেকে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা নিয়ে পালাতে চেয়েছিল। হয়তো ভবনের গ্রিল বেয়ে নামার চেষ্টা করেছিল, তখন হাত ফসকে নিচে পড়ে যায়। আমরা তো কিছুই জানি না। নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের খবর দেয় পড়ে আমরা বিষয়টি জানতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিহতদের পরিবারের সদস্যরা থানায় আসলে সেখানে আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন। ঘণ্টাব্যাপী পুলিশ নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে। পরে আমাদের চারজনকে ভেতরে নিয়ে যায়। তখন নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, তাদের কোনও দাবি নেই। তারা শুধু লাশ দুটি নিতে চান। তারা কোনও মামলা করতে চান না। তারা কিছু আর্থিক সহায়তা চাইলে তাদের তা দিতে বলা হয়।’
জসিমউদ্দিন রোডের ৪০ নম্বর বাড়ির কেয়ারটেকার আবু তাহের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাত সাড়ে তিনটার পরে উত্তরা-৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির নিরাপত্তাকর্মীরা পাশের ছাদ থেকে চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে হালিমা ও রুরিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে রুবী মারা যান। আমরা এই ঘটনা শুনে সেখানে গিয়েছিলাম।’
উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৪০ নম্বর বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছয়তলা ভবন এবং পাশের এক তলা ভবনের মাঝে ৬ ফুট দুরত্ব রয়েছে। ছয়তলা ভবনের ওপর থেকে নিচতলা পর্যন্ত বারান্দার গ্রিল রয়েছে। এদিকে পাশের একতলা বাড়ির ছাদে টবের পাশে নিহত রুবির একটি স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে ওই ছাদে কোনও রক্তের চিহ্ন বা ছাপ দেখা যায়নি। ছয়তলা ভবনের পাশের একতলা ভবনের সড়কের পাশে বিসমিল্লাহ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট রয়েছে।