X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় সিরিয়া ফেরত ‘আইএস জঙ্গি’ গ্রেফতার!

নুরুজ্জামান লাবু
০৬ মে ২০১৯, ২৩:১২আপডেট : ০৭ মে ২০১৯, ২২:১৮

 

গ্রেফতার ‘জঙ্গি’ মুতাজ আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-আইএসের হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে যাওয়া এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশানাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি। সিরিয়া ফেরত এই জঙ্গির নাম মুতাজ আব্দুল মজিদ কফিল উদ্দিন বেপারি ওরফে মুতাজ (৩৩)। সৌদি আরব থেকে সে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশে ফিরে আসে। গত রবিবার (৫ মে) বিকালে রাজধানীর উত্তরা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সোমবার (৬ মে) তাকে আদালতে সোপর্দ করে চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে সিটিটিসি। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সিটিটিসির উপ কমিশনার (ডিসি) মহিবুল ইসলাম খান জানান, ‘সৌদি আরব থেকে মুতাজ সিরিয়ায় গিয়েছিল। ঢাকায় আসার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা শওকত আকবর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মহানগর হাকিম ইয়াসমিনের আদালত শুনানি শেষে মুতাজের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। ওই ব্যক্তি সৌদি আরব থেকে আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করতে সিরিয়া গিয়েছিল।’

উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই  আব্দুল্লাহ ইবনে সাইয়ীদ সোমবার রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের হওয়া ওই মামলায় মুতাজ ছাড়াও অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এসআই  আশরাফুল হক বাবু বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এজাহারে মুতাজের সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করা এবং ঢাকায় এসে সরকার উৎখাতসহ নাশকতার পরিকল্পনার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।’

ঢাকায় সিরিয়া ফেরত আইএস জঙ্গি গ্রেফতারের খবরটি এমন দিনে এলো যার মাত্র ১৫ দিন আগেই প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় জঙ্গিদের সিরিজ বোমা হামলায় ৪০ জন শিশুসহ আড়াই শতাধিক মানুষ মারা গেছে। নিহতদের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় জায়ান চৌধুরী নামে এক শিশুও রয়েছে। জায়ান আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি।

শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ জঙ্গি হামলাতে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেকেই আইএসের হয়ে ইরাক ও সিরিয়াতে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। আইএসের পতন শুরু হলে তারা নামে-বেনামে নিজ দেশ শ্রীলঙ্কায় ফিরে যায়। শ্রীলঙ্কায় হামলার পর থেকে বাংলাদেশের নাগরিক ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিক, যারা ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, তারাও দেশে ফিরে নাশকতা করতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীর পরিকল্পনায় গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি ২২ জন নাগরিককে হত্যা করা হয়। তামিমও ২০১৩ সালের অক্টোবরে ঢাকায় আসার আগে কানাডা থেকে বিভিন্ন সময়ে ইরাক-সিরিয়ায় গিয়েছিল।

সিরিয়া ফেরত জঙ্গি মুতাজের গ্রেফতারের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা (নম্বর ৭) দায়ের করা হয়। এই মামলার এজাহার ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে একটি পাসপোর্ট (বিই-০০৪৯৬৯৬), সৌদি আরবের একটি আইডি কার্ড, সৌদি আরবের ড্রাইভিং লাইসেন্স, একটি আইফোন, ‘কাফিরের জন্য রক্ত আপনার জন্য লাল’ শিরোনামে আইএসের ম্যাগাজিন রুমিয়াহ’র চারপাতার একটি রচনার বাংলা অনুবাদ, ‘খিলাফত ঘোষণা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের ছয় পাতার একটি আর্টিকেল, আরবিতে লেখা ৫০ পাতার নথিপত্র এবং স্ম্যাসিং বর্ডারস ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ ফর্ম সিরিয়া রেভ্যুলেশন ২০১১ থেকে ২০২০ লেখা ১০৭ পাতার একটি বই উদ্ধার করা হয়।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার মুতাজ বাংলা বলতে পারে না। সে ইংরেজি ও আরবিতে কথা বলে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে নব্য জেএমবির ভাবধারায় বিশ্বাসী বলে স্বীকার করেছে। গত রবিবার (৫ মে) সে নব্য জেএমবির কয়েকজন সদস্যদের সঙ্গে উত্তরা এলাকায় বৈঠক করছিল। তারা নব্য জেএমবির মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও  নাশকতার পরিকল্পনা করছিল বলেও স্বীকার করেছে।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ জঙ্গি সামিউন

 ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কমলাপুর স্টেশন এলাকা থেকে সামিউন রহমান ওরফে ইবনে হামদান নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে ঢাকায় আইএস-এর জন্য সদস্য সংগ্রহ করছিল বলে সেসময় জানিয়েছিল পুলিশ। সিরিয়ায় আল-নুসরা ফ্রন্টের হয়ে যুদ্ধ করা সামিউন ঢাকার উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দিল্লি পুলিশের একটি বিশেষ দল তাকে সেখান থেকে গ্রেফতার করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সামিউন ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক হয়ে ঢাকায় প্রবেশ এসেছিল।

 

এর আগে ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ‘জঙ্গি’ সামিউন।

সিরিয়া ফেরত জঙ্গি গাজী সোহান

২০১৬ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি গাজী কামরুস সালাম ওরফে সোহান ওরফে আবু আব্দুল্লাহ নামে সিরিয়া ফেরত এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছিল বাংলাদেশ পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান- র‌্যাব। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সেই গাজী সোহান এখনও কারাগারে আটক রয়েছে। ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল। ২০১৫ সালের মে মাসে দেশে ফিরে আসার পর গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিল সোহান।

সিরিয়ায় আইএস এর হয়ে যুদ্ধ করে ফিরে আসা আরেক বাংলাদেশি ‘জঙ্গি’ গাজী সোহান।

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন করে গ্রেফতার হওয়া মুতাজ বংশানুক্রমে বাংলাদেশের নাগরিক। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌদি আরবে। সৌদিতে সে তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করতো। তার বাবা আব্দুর মজিদ বেপারী বাংলাদেশি হলেও মা হালিমা পাকিস্তানের নাগরিক। মুতাজ ২০১৪ সালে সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে। ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করে সে ২০১৬ সালে সৌদি আরব থেকে তুরস্ক যায়। তুরস্কে থাকাকালীন সময়ে সে সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওই সংগঠনের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। কিন্তু সেবার সিরিয়ায় ঢুকতে না পেরে ফের সৌদিআরবে ফিরে যায়। পরবর্তীতে সে ২০১৭ সালে মিশর ও তুরস্ক হয়ে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেবারও ব্যর্থ হয়ে সৌদি আরবে ফিরে যায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের মে মাসে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যায় সে এবং আইএসের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, গত বছরের শেষ দিকে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের পতন শুরু হলে অন্যদের মতো মুতাজও পালিয়ে তুরস্কে ফিরে আসে। সেখান থেকে সে গ্রিস হয়ে অন্য কোনও ইউরোপীয় দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তুরস্কের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান জোরদার করলে ইউরোপে না গিয়ে এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

সিটিটিসি’র সহকারী কমিশনার (এসি) অহিদুজ্জামান নূর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মুতাজকে রিমান্ডে এনেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে জানানো হবে।’

২০১৪ সালের ৩০ জুন ইরাক ও সিরিয়ায় জঙ্গি সংগঠন আইএস খিলাফত ঘোষণা করলে বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার তরুণ সেখানে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। যাদেরকে ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটার বা এফটিএফ বলা হয়। সেসময় বাংলাদেশ থেকে সরাসরি এবং বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইরাক ও সিরিয়াতে যায়। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে এমন অন্তত ৪০ জনের একটি তালিকা রয়েছে। যাদের অনেকেই এরইমধ্যে বিভিন্ন অভিযানে মারা গেছে হয়েছে। বাকিরা সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশি একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ঢাকায় মুতাজের অবস্থান সম্পর্কে প্রথমে তথ্য পাওয়া যায়। এরপর থেকেই তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলতে থাকে। পরবর্তীতে প্রযুক্তির মাধ্যমে ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ইরাক-সিরিয়ায় যারা আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল সেসব বাংলাদেশি এফটিএফ বা ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটারদের বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারা যাতে দেশে ফিরতে না পারে এজন্য তাদের বিষয়ে ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্টগুলোতে তালিকা দেওয়া হয়েছে। তারপরেও কেউ যদি দেশে ফেরার চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

/টিএন/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা