X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

তিন মাসেও পাল্টায়নি পুরান ঢাকার চিত্র, এখনও বহাল কেমিক্যাল গুদাম

শেখ জাহাঙ্গীর আলম
২৭ মে ২০১৯, ১০:০০আপডেট : ২৮ মে ২০১৯, ০০:১৮

বংশালের মাহুতটুলিতে গুদামে ঢুকছে কেমিক্যাল চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পর থেকে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম অপসারণে অভিযান শুরু করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এসব কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে কেরানীগঞ্জে নির্মাণাধীন কেমিক্যাল পল্লিতে স্থানান্তরের কথা থাকলেও ৩ মাসে তা বাস্তবায়ন হয়নি। পুরান ঢাকার বিভিন্ন জায়গাতে এখনও রয়ে গেছে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল বিস্ফোরণে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৭০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর তিন মাস পরও পুরান ঢাকার বংশাল, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, আরমানিটোলাসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন ভবনে রয়েছে কেমিক্যাল গুদাম। সরেজমিনে এসব এলাকার আবাসিক ভবনে গোপনে গোপনে গুদাম ভাড়া নিয়ে কেমিক্যাল রাখার চিত্র দেখা গেছে।

গত রবিবার ও সোমবার (১৯ ও ২০ মে) পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখনও অধিকাংশ ভবন থেকে কেমিক্যালের গুদাম সরানো হয়নি। বংশালের মাহুতটুলি এলাকায় সরেজমিন ঘুরে প্রতিটি ভবনের বাইরে কেমিক্যালের দোকান ও ভেতরে গুদাম দেখা গেছে। আরমানিটোলার শাবিস্তান হল গলি ও মিডফোর্ড রোডে গিয়ে দেখা গেছে অসংখ্য কেমিক্যালের গুদাম।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাত ১১টার পর এখানে বড় বড় কন্টেইনারে করে কেমিক্যাল আনা হয়। ভোরের আগেই ভবনে কেমিক্যাল ঢুকিয়ে ঘরবাড়ি তালা দিয়ে দেওয়া হয়।

মিটফোর্ড রোডে একটি পারফিউমারি অ্যান্ড কেমিক্যাল দোকান সরেজমিনে বংশালের মাহুতটুলির ৭৫ নম্বর বাড়ির নিচে কেমিক্যালের দোকান ও বাড়ির ভেতর গুদাম পাওয়া গেছে। পাশের গলির ভেতর ৭৬ ও ৭৭ নম্বর বাড়ি দুটিতে প্রায় ৫০ জন বাসিন্দা থাকেন। এই ভবনের নিচতলায় একটি গুদাম রয়েছে। ৭৯ নম্বর বাড়ির পেছন দিয়ে গুদামে যাওয়ার জন্য আলাদা দরজা রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝবে না এসব বাড়িতে এখনও কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে।

ভবনগুলোতে ঢুকতে চাইলে ভেতরে কিছু নেই বলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। তবে গোপনে একটি আবাসিক ভবনের ভেতর কেমিক্যাল তোলার চিত্র ধারণ করেছে বাংলা ট্রিবিউন।

মাহুতটুলির স্থায়ী বাসিন্দা ফাহিম আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন রাতে এসব বাসায় কেমিক্যাল রাখা হয়। কেমিক্যাল রাখার ফলে ক্ষতিকারক সাদা পাউডার আশপাশের বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।’ তিনি বলেন, ‘এলাকার যেসব বাসায় কেমিক্যাল গুদাম রয়েছে তাদের একাধিকবার অনুরোধ করার পরও তারা গুদাম সরায় না। পুলিশ কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থার আসলে বাসায় ঢুকতে দেয় না।’

ফাহিম বলেন, ‘চকবাজারের আগুনের পর আমরা আতঙ্ক নিয়ে এই ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছি।’ অবিলম্বে কেমিক্যাল গুদাম না সরালে চুড়িহাট্টার মতো আরও ট্র্যাজিডি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

আরমানিটোলার শাবিস্তান হল গলি ও মিডফোর্ড রোডে গেলে নাকে ঝাঁপটা মারে কেমিক্যালের ঝাঁজালো গন্ধ। এখানকার আবাসিক ভবনগুলোর গুদামে কেমিক্যাল আনা-নেওয়া করতে দেখা যায়। তবে এই এলাকার প্রায় সব কেমিক্যাল গুদামে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) দেখা গেছে।

বাংলা ট্রিবিউনের কাছে ছবি থাকলেও বংশাল এলাকায় কেমিক্যাল থাকার কথা অস্বীকার করেন বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাহিদুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে কেমিক্যাল গুদামগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বর্তমানে বংশাল থানা এলাকায় কেমিক্যাল গুদাম নেই। তবে তারা কেমিক্যালগুলো কেরানীগঞ্জ বা অন্য কোথাও মজুদ করে। সেখান থেকে মাল সাপ্লাই করেন ব্যবসায়ীরা।’

পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, আরমানিটোলা বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল বিক্রির বড় বাজার। বাংলাদেশের সব গার্মেন্টস শিল্প ও কল-কারখানায় ব্যবহৃত কেমিক্যাল এই বাজারেই কেনা-বেচা হয়। তবে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর এসব গুদাম থেকে দাহ্য কেমিক্যাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই বাজারে বর্তমানে সাধারণ কেমিক্যাল রাখা হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, কেরানীগঞ্জ কেমিক্যাল পল্লি এখনও প্রস্তুত হয়নি। তবু প্রসাশন ও সিটি করপোরেশনের অনুরোধে আরমানিটোলা ও মিডফোর্ড এলাকা থেকে দাহ্য কেমিক্যাল সরিয়ে শ্যামপুরে অবস্থিত ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে রাখা হয়েছে। বর্তমানে আরমানিটোলায় গুদামগুলোতে গার্মেন্টস আইটেম, ফুড আইটেম, ফার্মাসিটিক্যাল আইটেম ও পারফিউমারি আইটেমের কেমিক্যাল রাখা হয়েছে। এগুলো দাহ্য কেমিক্যাল নয়।

আরমানিটোলা এলাকার মিডফোর্ড রোডের দিদার পারফিউমারি অ্যান্ড কেমিক্যালের স্বত্বাধিকারী মো. আজিজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আরমানিটোলা এলাকায় এখন আর কোনও দাহ্য কেমিক্যাল গুদাম নেই। এখানে যা আছে সব মৌলিক কেমিক্যাল, এগুলো দাহ্য পদার্থ না। তবে ব্যবসার স্বার্থে কিছু কিছু দোকানে স্যাম্পল হিসেবে ১-২ লিটার অতিদাহ্য কেমিক্যাল রাখা হয়। তবে সেটির অনুমতি রয়েছে।’

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী আব্দুল জলিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আরমানিটোলা এলাকায় বর্তমানে কোনও দাহ্য কেমিক্যাল নেই। এখানে যেসব গুদাম রয়েছে তার সবই সাধারণ কেমিক্যাল। এগুলো দাহ্য কেমিক্যাল নয়।’

এদিকে ডিএসসিসি দাবিও করছে, বর্তমানে পুরান ঢাকার কোথাও কোনও কেমিক্যাল গুদাম নেই। আর বিস্ফোরক পরিদফতর বলছে, চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের পর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের কাজ পরিচালিত হয়েছে। এই অভিযানের মাধ্যমে অনেক কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণ করা হয়েছে। গোপনে কেউ এখনও পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গুদাম রেখেছে কিনা, সেটি অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনে আবারও অভিযান চালানো হবে। 

আরমানিটোলা শাবিস্তান হল গলিতে কেমিক্যাল গুদাম ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গুদাম অপসারণে গঠিত টাস্কফোর্সের অভিযানে মোট ১৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ২৭টি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়। সময় দেওয়া হয় ৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে। সেইসঙ্গে জরিমানা করা হয় মোট ৯৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। নিয়ম মেনে গুদাম সরিয়ে নেওয়ায় ১৬টি প্রতিষ্ঠানের ইউটিলিটি সার্ভিস পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিস্ফোরক পরিদফতরের ঘোষিত ৩৬টি অতিদাহ্য কেমিক্যাল আইটেম বর্তমানে পুরান ঢাকায় নেই। আরমানিটোলায় গুদামগুলোতে যেসব কেমিক্যাল বিক্রি করা বা রাখা হচ্ছে, সেগুলো দাহ্য নয়। সেগুলোর অনুমতি রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে কেরানীগঞ্জে কেমিক্যাল পল্লি নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেটি নির্মাণ হলে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা থেকে সব কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. সামসুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা গত ১ এপ্রিল পর্যন্ত দাহ্য কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের অভিযান পরিচালনা করছি। এর মধ্যে অনেকটা সময় চলে গেছে। আমরা বিষয়টি অবজারভেশনে রেখেছি। বিভিন্ন তদন্ত সংস্থাও তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে।’

 তিনি বলেন, ‘যারা এখনও গোপনে গোপনে ঘরের ভেতর বা বাড়িতে কেমিক্যাল গুদাম রেখেছে তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। ঈদের পর যদি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আবারও অভিযান পরিচালনা করে, তবে আমরা সেখানে থাকবো।’

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মজনু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা কেমিক্যাল (টুথপেস্ট) ব্যবহার করি। পানি পরিশোধনের জন্য কেমিক্যাল লাগে। কেমিক্যাল আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেমিক্যাল ব্যবসা বন্ধ হলে বাংলাদেশের সব কল-কারখানা অচল হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের জন্য কেরানীগঞ্জে একটি প্লট দেবে বলেছে। সেটি সরকার সুবিধামতো তৈরি করে দিলে আমরা সবাই সেখানে চলে যাবো।’ আরমানিটোলা এলাকায় গুদামগুলোতে বর্তমানে যেসব কেমিক্যাল রয়েছে, সেগুলোর সব কটির অনুমতি রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

তবে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা এলাকায় কোনও কেমিক্যাল গুদামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে প্লাস্টিক দানার অসংখ্য গুদাম রয়েছে, যা দাহ্য পদার্থের অন্তর্ভুক্ত নয়।

 

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে  ইসরায়েল?
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে ইসরায়েল?
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা