X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘নদীকে মায়ের মতো সম্মান দেখাতে হবে’

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
১১ জুন ২০১৯, ২৩:০০আপডেট : ১১ জুন ২০১৯, ২৩:২৩

‘নদী ও ধর্ম’ শীর্ষক বৈঠকিতে আলোচকরা ‘মায়ের প্রতি যে সম্মান দেখানো হয়, নদীর প্রতিও তেমনি সম্মান দেখাতে হবে। আমরা যদি একটু সংগ্রাম করে নদীকে ভালো অবস্থায় আনতে পারি, তাহলে দেশের অবস্থাও অনেক ভালো হবে।’ দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের আয়োজনে ‘নদী ও ধর্ম’ শীর্ষক বৈঠকিতে এসব কথা বলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস এবং নদী ও পানি সম্পদ বিষয়ক গবেষক ড. আইনুন নিশাত। মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় মঙ্গলবার (১১ জুন) বিকালে পান্থপথে বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিওতে আয়োজিত হয় সাপ্তাহিক এই আয়োজন। 

আজকের বৈঠকিতে আলোচনায় আরও অংশ নিয়েছেন– জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক একেএম শাহনেওয়াজ, সাউথ অ্যান্ড সাউথ-ইস্ট এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব কালচার অ্যান্ড রিলিজিয়নের (এসএসইএএসআর) সভাপতি অমরজিভা লোচান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) অধ্যাপক শাহনাজ হুসনে জাহান ও অধ্যাপক সুমন রহমান এবং বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশীদ।

ড. আইনুন নিশাত এ সময় আলোচনায় ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমি আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন দেখেছি, সদরঘাটে সকালবেলা সনাতন দম্পতি বুকসমান পানিতে দাঁড়িয়ে সূর্যদর্পণ করতেন। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা একটি তীর্থস্থান ছিল। এ থেকে নদী ও ধর্মের সম্পর্ক বোঝা যায়। কিন্তু আজকে আমি বুড়িগঙ্গার বুকপানিতে কাউকে দাঁড়াতে বলতে পারবো না। কারণ চর্মরোগ হবে। এই যে একটা ধর্মস্থান নষ্ট হয়ে গেল,  এ থেকে বোঝা যায়– আমরা কীভাবে নদীকে ব্যবহার করছি; তার ভৌত পরিবেশ দখল করছি; তার জীববৈচিত্র্য নষ্ট করছি। আগে আমরা নদীকে সম্মানের জায়গায় রাখতাম।’

নদীর গুরুত্ব উপলব্ধি করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নদীকে আমাদের বুঝতে হবে। আমি সারাজীবন নদীকে বোঝার চেষ্টা করছি। নদীর ধর্ম, নদী কেমন আচরণ করে ইত্যাদি। নদীর সঙ্গে সরাসরি ধর্ম আছে। হিন্দুরা গঙ্গাকে দেবী মনে করেন। আবার নদীর পাড়ে অনেক তীর্থস্থান আছে। ঢাকা থেকে ৩০-৪০ কিমি দূরে লাঙ্গলবন্দ তীর্থস্থান।’

একেএম শাহনেওয়াজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক একেএম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘ধর্মের সঙ্গে নদী নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার কোনও উপায় নেই। মানবসভ্যতা ধ্বংস হওয়ার অনেকগুলো কারণের একটি হলো, নদীর গতি পরিবর্তন বা ভিন্ন আচরণ।’

নদীর সঙ্গে এদেশের মানুষের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নদীর নামগুলো একটু বেশি মিষ্টি, সরল। এই নামগুলো কিন্তু আমাদের জীবনবোধ থেকেই তৈরি হয়েছে। আমাদেরই পূর্বপুরুষ কেউ নামগুলো দিয়েছেন। মানুষ যেভাবে চিন্তা করে,  কৃতকর্মের সঙ্গে তার মিল থাকে।’ 

অমরজিভা লোচান সাউথ অ্যান্ড সাউথ-ইস্ট এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব কালচার অ্যান্ড রিলিজিয়নের (এসএসইএএসআর) সভাপতি অমরজিভা লোচান বলেন, ‘এসএসইএএসআর একটি বড় আঞ্চলিক সংস্থা। ১৮-১৯টি দেশ থেকে স্কলাররা এই সম্মেলনে আসেন। ৬০টির মতো দেশ এতে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশকে পশ্চিমা মিডিয়া নেতিবাচকভাবে তুলে ধরায় এবার মাত্র ৩০টি দেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পেরেছি। এবার আমরা নদী বিষয়ে সম্মেলন করতে যাচ্ছি। নদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।’

নদী ও ধর্ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  ‘বাংলাদেশ হাজার নদীর দেশ। অন্য কোনও দেশকে এভাবে হাজার নদীর দেশ বলা হয় না। আমরা ধর্ম চর্চা করি, কিন্তু ধর্মের ভেতরে যাই না। ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতিকে আমরা সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরি।’ 

শাহনাজ হুসনে জাহান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) অধ্যাপক শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, ‘যখন জানলাম, সাউথ অ্যান্ড সাউথ-ইস্ট এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব কালচার অ্যান্ড রিলিজিয়ন  (এসএসইএএসআর) দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সব গবেষকদের গবেষণা উপস্থাপন করবে। সেখানে একটি প্রতিপাদ্য দরকার। আমি প্রথমে চিন্তা করলাম, বাংলাদেশকে আমি কী দিয়ে তুলে ধরতে পারি? তখনই আমার সামনে নদীগুলো ভেসে উঠলো। কারণ বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। হাজার নদীর দেশ। এই হাজার হাজার নদীর তীর ঘেঁষেই সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ ও সভ্যতার নিদর্শনগুলো সবই নদীর তীর ঘেঁষে পাওয়া গেছে।’    

এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘এসএসইএএসআর কনফারেন্স করে দুই বছর পরপর। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে তারা এই আয়োজন করে যাচ্ছে। আমি এই কনফারেন্সের সঙ্গে গত ২০ বছর যাবৎ জড়িত। কনফারেন্সগুলোতে গিয়ে আমার কাছে একটি কথাই মনে হতো, বাংলাদেশে এটা আমি কবে করবো? কারণ এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত পৃথিবীর প্রায়  ৬০০ ইউনিভার্সিটি ও সেগুলোর শিক্ষক, গবেষক। হাভার্ড থেকে শুরু করে সব ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত আছেন তারা। সেখানে যখন কনফারেন্স হয়, সেটি বড় একটা মিলনমেলায় পরিণত হয়।’

সুমন রহমান ইউল্যাবের অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, ‘ধর্মকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করা যায়। সংস্কৃতির অংশ হয়ে পাঠ করা যায়, বিজ্ঞানের জায়গা থেকে পাঠ করা যায়, রাজনীতির জায়গা থেকে পাঠ করা যায়।’

সাউথ অ্যান্ড সাউথ-ইস্ট এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য স্টাডি অব কালচার অ্যান্ড রিলিজিয়নের (এসএসইএএসআর) সম্মেলনের আয়োজন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউল্যাবে আমরা লিবারেল আর্টস নির্ভর শিক্ষা প্রদান করি। শিক্ষার্থীকে কিছু বোঝাতে গেলে আমরা বিভিন্ন প্রেক্ষাপট যেমন– বিজ্ঞান, রাজনীতির মাধ্যমে আলো ফেলার চেষ্টা করি। একটা মাল্টি ডিসিপ্লিন পাটাতন তৈরি করার চেষ্টা থাকে। এ অবস্থায় এসএসইএএসআরের এরকম একটা সম্মেলনের প্রস্তাব আমাদের কাছে আসলো। আমরা ভেবে দেখলাম যে, এটা অনেক গভীর একটা জায়গা। এখানে শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনার দরজা খোলার বহু উপাদান আছে।’      

হারুন উর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশীদ নদীরক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগের দীর্ঘসূত্রতার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,  ‘নদীরক্ষায় বিভিন্ন মহলে ইদানীং সচেতনতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সচেতন হতে হতে নদী থাকবে তো? ক্ষমতাবানরা সব সময় চান, নদী দখল করে ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু তারা এটি বুঝতে চান না যে, যখন একটি গাছ থাকবে না, একটি নদী থাকবে না, তখন বেঁচে থাকার উপকরণগুলোও থাকবে না। তারা বুঝতে পারেন না যে, টাকা কিন্তু খাওয়া যায় না।’

নদীরক্ষায় সাংবাদিক ও তরুণদের এগিয়ে আসার প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা নদী নিয়ে ইদানীং খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এর অবদান আমি আইনুন নিশাত স্যারদের দিতে চাই। তারা ধরিয়ে দিয়েছেন নদী দখলের মূল কারণ। নদী দখলের সঙ্গে ক্ষমতার একটি সম্পর্ক আমরা সাংবাদিকরা সব সময় দেখেছি। সেই জায়গাগুলো সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একদিকে যেমন নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে, অন্যদিকে কিন্তু নদীকে ভালোবাসার মানুষও বাড়ছে। বিশেষ করে আমি সাংবাদিক হিসেবে দেখি, তরুণরা নদী নিয়ে ভাবেন। নদীকে দেখতে দল বেঁধে তরুণরা যাচ্ছেন, গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। এটি কিন্তু অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। আরেকটি বড় ইতিবাচক হলো, ঢাকায় নদী নিয়ে বড় সম্মেলনটি হবে। নদীরক্ষায় সবাই এগিয়ে আসছে।’         

মুন্নী সাহা এ বৈঠকি সরাসরি সম্প্রচার করেছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ। পাশাপাশি বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক ও হোমপেজে লাইভ দেখা গেছে এ আয়োজন। ইউল্যাবের সহযোগিতায় বৈঠকিটি আয়োজিত হয়েছে। 

 

/এসও/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
লেবাননে এক হিজবুল্লাহ কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
লেবাননে এক হিজবুল্লাহ কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
চুরি ও ভেজাল প্রতিরোধে ট্যাংক লরিতে নতুন ব্যবস্থা আসছে
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
প্রকৃতির লীলাভূমি সিলেটে পর্যটকদের ভিড়
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন