X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একজন পোশাক শ্রমিকের মজুরি, এক মাসের গল্প

উদিসা ইসলাম
২৩ জুন ২০১৯, ১১:০০আপডেট : ২৩ জুন ২০১৯, ১৮:৪২

গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রতিদিনের জীবন

রাবেয়া, পোশাক কারখানার একজন অপারেটর। ওভারটাইমসহ বেতন পান ১১ হাজার টাকার কাছাকাছি। পোশাক শ্রমিকদের জন্য বানানো এক ছাউনির নিচে একটি ঘরে স্বামী-সন্তানসহ থাকেন। ভাড়া ৩ হাজার টাকা। ভাড়ার শর্ত, জানুয়ারি আর জুনে ২০০ টাকা করে বাড়বে। রাবেয়ার স্বামী হেপাটাইটিস-সি আক্রান্ত, মাসে ওষুধ লাগে ৪ হাজার টাকার। বাকি মাসের হিসাব দেওয়ার আগে রাবেয়া ক্ষোভের সঙ্গে বলেন: ‘আপনার জন্য যে লাউ ৬০ টাকা, আমার জন্য ৩০ টাকা না, ওই ৬০ টাকাই। শুনতে চান আর কীভাবে চলি?’

শুধু রাবেয়া নন, রাবেয়ার মতো লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক প্রতিমাসের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। রাবেয়া বলেন, ‘বাসায় ফিরে এসে রান্না চড়িয়ে কাপড় সেলাই করতে বসি। ভোররাত পর্যন্ত কাপড় সেলাই করি। আর ছেলের বয়স ৭ বছর হলেও স্কুলে দিতে পারিনি। তাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করবে কে? আর টাকার জোগানই বা দেবে কে?’ বিনা বেতনে পড়া যায় যে সরকারি স্কুলে তা বাড়ির আশপাশে না থাকায় পোশাক শ্রমিকের সন্তান শ্রমিকই হবে বলে হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।  

সবার আছে বাঁধা মুদির দোকান

বাঁধা মুদির দোকানের ওপরে চলে পোশাক শ্রমিকদের বেশিরভাগ পরিবার। এ মাসের টাকা ও মাসে শোধ করে চলে সেই ধারাবাহিক ঋণ। হেলপার বেলায়েত বলেন, ‘আমার ঘরভাড়া আর বাচ্চার খরচেই সবটা চলে যায়। এরপর খাবো কী? পাড়ার মুদির দোকানে মাসিক লেনদেন চলে। ডিম হলো সর্বোচ্চ ভালো খাওয়া। মাংস বলতে ব্রয়লার মুরগি। মাছ-মাংসে যা হাত দেওয়া যায়, সবজিতে হাত দেওয়া যায় না। দিনশেষে কম দামে সবজি বিক্রি হয়, সেগুলো কিনে বেছে খাওয়া হয়।’

এই ঘিঞ্জি পরিবেশই যেন তাদের নিয়তি আরেক হেলপার শামীমা বলেন, ‘আমরা ৩ ভাইবোন একসঙ্গে থাকি, ৩ জনের দুজন গার্মেন্টসে কাজ করি, একজন গাড়ির ড্রাইভার। ৩ জনের আয়ে সংসার ভালোমতোই চলে।’ গার্মেন্টসের একজনের আয়ে কোনও জীবন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভ

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রমিকদের সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার টাকা৷ এরমধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ টাকা, খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা৷

এই টাকায় পরিবার নিয়ে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব বলে জানাচ্ছেন শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, থাকা-খাওয়া, সন্তান লালনপালনের ন্যূনতম সুবিধা ছাড়াই জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।

শ্রমিক নেতারা আরও বলছেন, ক্রেতা, মালিক ও সরকারের ত্রিমুখী সদিচ্ছা ছাড়া পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হবে না। আর এর ওপর বাজেট মানেই তো মূল্যবৃদ্ধি। মালিকদের প্রণোদনা দেওয়া হলেও শ্রমিকদের জন্য বাজেটে কিছু নেই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।

বরাবরই ঘাটতি বাজেট

শ্রমিকের জন্য যে বেতন চাওয়া হয় বরাবরই তার চেয়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার ঘাটতি থাকে। গত ৪০ বছর ধরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বাইরে পোশাক শ্রমিকদের শ্রমে তৈরি পোশাক রফতানিতে আয়ই প্রধান। অথচ এই খাতের শ্রমিকদের মজুরি অন্য সব খাতের চেয়ে কম।

প্রতিদিনের জীবন ১৯৯৪ সালের ঘোষিত মজুরি ৯৩০ টাকা ২০০৬ সালে বেড়ে হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। ২০১০ সালে মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ৩ হাজার টাকা। কিন্তু তখন ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা করার দাবি ছিল। ২০১৩ সালে গঠিত মজুরি বোর্ড মজুরি নির্ধারণ করে ৫ হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৮ সালে তাদের বেতনের ১১টি গ্রেড করা হয়। এরমধ্যে শ্রমিকদের জন্য ৭টি ও কর্মচারীদের জন্য নির্ধারণ করা হয় ৪টি। ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার নির্ধারণ করা হয়। যদিও জীবনযাপনের ব্যয় হিসাব করে ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকা করার দাবি ছিল।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘শ্রমিকদের জীবন তো বরাবরই ঘাটতি বাজেটে যায়। যেটুকু ন্যূনতম দরকার তারচেয়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা কমিয়ে তাদের মজুরি নির্ধারিত হয়। ফলে তাদের জীবনমান বাড়বে কীভাবে? তারা বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।’

শ্রমিকদের কল্যাণে যে পরিমাণ রফতানি আয় আসে সে তুলনায় তাদের বেতন বাড়ানোয় অনীহা কেন—জানতে চাইলে গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি লীমা ফেরদৌস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মালিক বিজিএমইএ-এর সহায়তায় যত সহজে সরকারের কাছে পৌঁছায়, শ্রমিকের স্বর আমাদের মাধ্যমে তত দ্রুত পৌঁছায় না। এটা আমাদের ব্যর্থতা।’ তিনি বলেন, ‘মালিকপক্ষ আশি-নব্বই দশকে গার্মেন্টস-এর লাভের যে অঙ্ক, সেটি ভুলতে পারেন না। তারা মনে করেন, ঠিক সেই পরিমাণ লাভই সবসময় থাকবে। কিন্তু ক্রেতাদের চাহিদা, গার্মেন্টসের কমপ্লায়েন্স—সব মিলিয়ে এখন সেই অবস্থা নেই।’ এরপরও যে লাভ হয় সেটির একটি অংশও যদি শ্রমিকের জন্য ভাবা হতো তাহলে সুদিন ফিরতে সময় লাগতো না বলে দাবি করেন তিনি।

মালিকপক্ষের বক্তব্য

মজুরি বোর্ডে মালিক পক্ষে কাজ করেছেন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি মনে করেন, শ্রমিকের বর্তমান বেতন ঠিকই আছে। নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে। নতুন কোনও মজুরি বোর্ড হওয়া উচিত হবে না। তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের যে বেতন এখন দেওয়া হচ্ছে তা যথেষ্ট, এবং এটা নিশ্চিত করতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি।’

গত এক বছরে দেড় হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে দাবি করে তিবি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আর বেতন বৃদ্ধি যৌক্তিক না। ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখতে চাইলে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের সহযোগিতা লাগবে।’

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

/এইচআই/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা