X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুদকের নজরদারিতে আবাসন শিল্প

দীপু সারোয়ার
১৪ আগস্ট ২০১৯, ১২:২৮আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০১৯, ১৫:৪০

নির্মাণাধীন বহুতল ভবন

আস্থার সংকটে পড়েছে আবাসন শিল্প। নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণ, ফ্ল্যাট বিক্রিতে অনিয়ম, চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে আবাসন শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণকে গুরুত্ব দিয়ে অভিযানও শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন,দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য। এ বিষয়ে দুদকের হটলাইন ১০৬ নম্বরে বেশি অভিযোগ আসছে বলেও জানান তিনি।

তবে আবাসন খাতের সরকার স্বীকৃত একমাত্র সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) বলছে, ফ্ল্যাট হস্তান্তরসহ নানা সমস্যা নিয়ে রিহ্যাবে ৫০০ অভিযোগ জমা আছে। তবে এসব অভিযোগ বিপজ্জনক পর্যায়ে আছে বলে মনে করে না এই সংগঠনটি। প্রসঙ্গত, রিহ্যাবের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১০৫৪টি। এই সদস্যরা বছরে প্রায় ১১ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি করে থাকে।

নকশা বহির্ভূত শীতল গ্র্যান্ড প্যালেস

রাজধানীর বনশ্রীতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নকশা অমান্য করে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে ‘শীতল প্রপার্টিজ লিমিটেড’ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানি। ‘শীতল গ্র্যান্ড প্যালেস’ নামে ওই বহুতল ভবন নির্মাণের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুদফা নোটিশও পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারপরও ভবন নির্মাণ বন্ধ না করায় গত ১৮ জুলাই সেখানে অভিযান চালায় দুদক। দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আফরোজা হক খানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এই অভিযান। পরে রাজউকের নকশা অমান্য করে ভবন নির্মাণের কারণে শেষবারের মতো চূড়ান্ত নোটিশ পাঠায় দুদক। একইসঙ্গে চূড়ান্ত নোটিশ অমান্য করলে রাজউকের জোন-৬ এর অথরাইজড অফিসারকে ভবনের নির্মিত অংশ উচ্ছেদের সুপারিশ করে দুদক টিম।

ভবন নির্মাণের তদারকিতে রাজউকের অনিয়ম

হটলাইনে অভিযোগ পেয়ে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম গত ১৫ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অভিযানে চালায়। সেখানে ভবন নির্মাণের তদারকিতে থাকা রাজউকের অনিয়মের তথ্য মেলে। তাজমহল রোডে ডি বিল্ডার্স অ্যান্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেড নামে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান রাজউকের বিধি লঙ্ঘন করে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে বলে অভিযান চলাকালে প্রমাণ পায় দুদক। এসময় রাজউক জোন-৩ এর কর্মচারীরাও দুদক টিমের সঙ্গে ছিলেন।
অভিযানের সময় দুদক টিম ও রাজউক জোন-৩ এর সদস্যরা দেখতে পান, ভবনের চারপাশে যে পরিমাণ জায়গা রাখার কথা তা রাখা হয়নি। ভবন নির্মাণে অনিয়মের বিষয়ে এলকাবাসীর আপত্তিও বেশ পুরনো।  আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে ডি বিল্ডার্স অ্যান্ড প্রোপার্টিজকে গত বছর ভবন ভেঙে ফেলার জন্য রাজউক চূড়ান্ত নোটিশও দিয়েছিল। পরে ওই নোটিশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে আবাসন প্রতিষ্ঠানটি। এ বছরের জানুয়ারিতে ওই রিট খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু রিট খারিজ হওয়ার সাত মাস পরও রাজউক নতুন করে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

সময় মতো ফ্ল্যাট বুঝে না পাওয়ার অভিযোগ বেশি

দুদকের অভিযোগ কেন্দ্রে (হটলাইন-১০৬)বিধি লঙ্ঘন করে বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ করেন তিনজন ফ্ল্যাট মালিক। এরপর গত ২৬ মে নিউ বেইলি রোডে অভিযান চালায় দুদক। অভিযানের সময় নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নোটিশ দেয় দুদক। এসময় দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের সঙ্গে রাজউক জোন-৬ এর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।  

রাজউকের নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণকে কেন্দ্র করে নানা অভিযোগ ছাড়াও ফ্ল্যাট কেনা নিয়েও প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। আর এসব অভিযোগের বিষয়ে রিহ্যাব সচেতন আছে বলে জানিয়েছেন রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভুঁইয়া। তিনি জানান, আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তারা সেটা খতিয়ে দেখেন এবং তদন্ত করে ব্যবস্থা নেন।

রিহ্যাব বলছে, ফ্ল্যাট কেনার পর সময় মতো বুঝে না পাওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি জমা পড়ে। সরেজমিনে এ তথ্যের সত্যতাও মেলে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন অনেক কোম্পানি আছে, যারা ফ্ল্যাট বা বাণিজ্যিকভাবে ফ্লোর বিক্রির নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের পর উধাও হয়ে গেছে। কোম্পানি ও ব্যক্তির বিরুদ্ধেও এধরনের হয়রানির তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায়, কিছু ডেভেলপার ভবনের শুধু কাঠামো তৈরি করে ভেতরের সব কাজ ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেয়। মেয়াদ শেষে চুক্তি অনুযায়ী অন্যান্য সিভিল ওয়ার্ক, স্থাপনা যেমন-ট্রান্সফরমার, জেনারেটর, সোলার প্যানেল, লিফট, ইন্টারকম স্থাপন না করে সটকে পড়ে। আর এক্ষেত্রে রিহ্যাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা অন্যান্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনও সহযোগিতা পান না গ্রাহকরা। অথচ এ খাতে সরকারের যে রাজস্ব আয়, তার জোগানদাতা ক্রেতারা, ডেভেলপাররা না। 

ফ্ল্যাট অথবা টাকা ফেরত চাই

প্রায় আড়াই বছর আগে মিরপুর ডিওএইচএস এলাকার ৭ নম্বর রোডের ৪২৩ নম্বর ভবনের ৩/এ নম্বর ফ্ল্যাটটি কেনেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রকৌশলী দেওয়ান শামসুল হুদা। ফ্ল্যাটের মালিক মুশরাত জাহানকে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। এরপর হুদা দম্পতি তাদের ফ্ল্যাটে ওঠেন। কিন্তু তখনও ফ্ল্যাটটি তাকে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়নি। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর হুদা দম্পতিকে ওই ফ্ল্যাট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গত বছরের ২ অক্টোবর আদালত মুশরাতকে এক বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি ৪০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের রায় দেন। তবে কারাদণ্ডের রায় হলেও গ্রেফতার হননি মুশরাত। শামসুল হুদা বলেন, ‘ফ্ল্যাট অথবা টাকা ফেরত চাই।’

ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেডের প্রতারণা

ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেড, রিহ্যাবের সদস্য এই কোম্পানিটি আবাসন ব্যবসা শুরু করে ২০০৯ সালে। বারিধারা, গুলশান, উত্তরাসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় জমি কিনে ফ্ল্যাট নির্মাণের ঘোষণা দেয় এই প্রতিষ্ঠান। এরপর ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সাত বছরে গ্রাহকদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫০ লাখ টাকা থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা পর্যন্ত অগ্রিম নেয় তারা। এভাবেই প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে ৫০ কোটিরও বেশি টাকা। এরপর থেকে ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেড হাওয়া হয়ে যায়। এখন কোথাও এই প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলছে না।

কোম্পানির নিবন্ধন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের তথ্য অনুযায়ী ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলেন খন্দকার রইস উদ্দিন আহমেদ। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন তার স্ত্রী নূরানা আহমেদ। তাদের দুই সন্তান খন্দকার ইরাদ আহমেদ ও খন্দকার ইয়াকিদ আহমেদ হলেন প্রতিষ্ঠানের দুই পরিচালক। ১০৭ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় কার্যালয় থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও সেখানে ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজির কিছুই নেই। গুলশান অ্যাভিনিউয়ের সুবাস্তু ইমাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় ট্রাস্ট অ্যালায়েন্সের অফিস ছিল এক সময়। রিহ্যাবের সদস্য পদ নেওয়ার সময় এই ঠিকানাই ব্যবহার করেছিল কোম্পানিটি। কিন্তু এখানেও তাদের সন্ধান মেলেনি।

গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ৫১ নম্বর সড়কের পাশে ১০ কাঠা প্লটের মালিক মাহী জাবিন ও মুসাররত জাবিন। ওই প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য মাহী ও মুসাররত ট্রাস্ট অ্যালায়েন্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে খন্দকার রইস উদ্দিন আহমেদকে আম-মোক্তার নিয়োগ করেন। পরে প্লটে ‘জাবিন অ্যালায়েন্স’ নামে নির্মাণাধীন ভবনের সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহজাহান ২০১৩ সালের ২১ জুলাই ‘জাবিন অ্যালায়েন্স’র লেভেল ৬-এ ছয় হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও তিনটি কার পার্কিংয়ের জায়গা কেনার জন্য ১২ কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন। ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত মোহাম্মদ শাহজাহান ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। পরে প্লটে পাইলিং শুরু হলেও আর কোনও অগ্রগতি হয়নি। প্রতারণার শিকার হয়ে মোহাম্মদ শাহজাহান মামলা করেছেন। আর সেই মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।  মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হলেন ইন্সপেক্টর হুমায়ুন কবির মোল্লা। পিবিআই এখনও পর্যন্ত ট্রাস্ট অ্যালায়েন্সের প্রতারণা নিয়ে সাতটি মামলার তথ্য পেয়েছে।

ট্রাস্ট অ্যালায়েন্সের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের কথা শিকার করেন রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভুঁইয়া। রিহ্যাব জানায়, প্রতারণায় অভিযুক্ত আবাসন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রিহ্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রিহ্যাব প্লট ও ফ্ল্যাটের ক্রেতা এবং ভূমির মালিকদের বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে পাঁচটি ডেভেলপার কোম্পানির সদস্যপদ বাতিল করে। ২০১৫ সালে ৮টি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে বহিষ্কার করে। ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি চার ডেভেলপার কোম্পানির সদস্যপদ বাতিল করে। আর ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইডিয়াল রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের সদস্যপদ বাতিলের তথ্য জানায় রিহ্যাব।

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুদক
রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির অভিযোগবিজেএমসির চেয়ারম্যানসহ তিনজনের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুদক
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
একনেকে ১১পি প্রকল্প অনুমোদন
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
ইউনেস্কোর ‘ট্রি অব পিস’ বিষয়ে যা বলছে ইউনূস সেন্টার
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
বিএসএফের গুলিতে নিহত যুবকের মরদেহ হস্তান্তর
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে
রাজধানীর ৫ জায়গায় তরমুজ বিক্রি হবে কৃষকের দামে