নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে শুক্রবার (৪ অক্টোবর) রাত থেকে আন্দোলন করে আসছেন মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পবাসী। সেই আন্দোলন পরদিন (শনিবার) সকাল থেকে সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে পুলিশ সদস্যসহ অর্ধশত আহত হন। সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১২ জনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় পুলিশের কাজে বাধা, হামলা ও অগ্নিসংযোগহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
সংঘর্ষের সূত্রপাত
ক্যাম্পবাসীর অভিযোগ, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সেখানে কিছুক্ষণ পরপর লোডশেডিং শুরু হয়। মৌখিকভাবে এ বিষয়ে বিদ্যুৎ অফিসের কাছে স্থানীয় কমিশনারকে নিয়ে অভিযোগও করেন বিহারি নেতারা। সবশেষ বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পরও লোডশেডিং পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি।
এরপর শুক্রবার (৪ অক্টোবর) রাতে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সামনে সড়ক অবরোধ করেন বিহারিরা। পুলিশ তাদের বুঝিয়ে রাতে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয়। এরপর শনিবার (৫ অক্টোবর) সকাল থেকে ক্যাম্পের বাসিন্দারা বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। শনিবার দুপুরে তারা ক্যাম্পের বাইরে চলে আসেন। সড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ তাদের ক্যাম্পের ভেতরে পাঠাতে প্রথমে ব্যর্থ হয়। এরপর স্থানীয় কমিশনার হাবিবুর রহমান মিজানের সহযোগিতায় বিহারিদের সঙ্গে মধ্যস্থতার চেষ্টা করা হয়। এ সময় বিহারিরা কমিশনারকে লাঞ্ছিত করেন। ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর পুলিশ, স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুসারীরা মিলে বিহারিদের ধাওয়া দেয়। শুরু হয় সংঘর্ষ। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পবাসী ও পুলিশের মধ্যে। দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত দফায় দফায় এই সংঘর্ষ চলতে থাকে। পুলিশকে লক্ষ করে ক্যাম্পবাসী ইটপাটকেল ছোড়ে। এ সময় আত্মরক্ষার্থে পুলিশও টিয়ারলেশ ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায়। এই ঘটনায় পুলিশের ১৫-২০ জন সদস্য আহত হয়েছেন। এরপর বিকাল ৩টার দিকে জেনেভা ক্যাম্পের ভেতর অভিযান চালায় পুলিশ। পরে সেখান থেকে ১২ জনকে আটক করা হয়।
জেনেভা ক্যাম্পে নেই বিদ্যুতের মিটার
জেনেভা ক্যাম্পে সাড়ে ৫ হাজার পরিবারের বসবাস। সে হিসেবে পুরো ক্যাম্পে সাড়ে ২৭ হাজার লোকের বসবাস। রাজধানীর ভেতরে থাকা বিহারিদের অন্যান্য ক্যাম্পের মধ্যে জেনেভা ক্যাম্প ঘনবসতিপূর্ণ। ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছেন, ভেতরে কোনও ঘরেই বৈদ্যুতিক মিটার নেই। কারণ, ক্যাম্পে কারও বাড়ির হোল্ডিং নম্বর নেই। হোল্ডিং নম্বর ছাড়া ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) কোনও বিদ্যুৎ মিটার দেয়নি। তাই কারও ঘরে মিটার নেই। ক্যাম্পের বাসিন্দারা বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার থেকে সরাসরি বিদ্যুতের সংযোগে টেনে একটি পয়েন্টে নেন। সেখান থেকে সবার ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয় বলেও তা জানান।
পুনর্বাসিত হয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল দিতে চান বিহারিরা
নাগরিক হলেও এখনই ক্যাম্পে থাকা বিহারিরা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল দিতে রাজি নন। পুনর্বাসিত হওয়ার পরই তারা সেবা প্রতিষ্ঠানের বিল দিতে চান। তবে, ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশের সব নাগরিক বিদ্যুৎ বিল দেবে। তাদেরও বিল দিতে হবে। এ বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিফিউজি কমিটির (এসআরজিআরসি) সাধারণ সম্পাদক মো. শওকত আলী বলেন, ‘এখনও আমাদের অনেকেই গরিব। তাদের কাজও নেই। পরিবার চালাতে পারছেন না। তাদের অনেকে নাগরিক হয়েছেন সত্য কিন্তু পুনর্বাসিত হননি। তারা কীভাবে বিদ্যুৎ বিল দেবেন? আমরা বলছি তাদের পুনর্বাসন করা হোক। তারপরও যাদের সামর্থ্য আছে, তারা দিতে পারেন বিদ্যুৎ বিল। তাদের মিটার দেওয়া হোক।’ তিনি বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পের কারও ঘরে বৈদ্যুতিক মিটার নেই। এখানে কারও কোনও হোল্ডিং নম্বর নেই। তবে আমরা কীভাবে বিদ্যুৎ বিল দেবো? হোল্ডিং নম্বর ছাড়া বৈদ্যুতিক মিটার দেওয়া হয় না।’
পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর
পুলিশের দাবি, এই সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের ১৫-২০ সদস্য আহত হয়েছেন। তবে ক্যাম্পবাসীর অভিযোগ—শতাধিক বিহারি (নারী-পুরুষ) আহত হয়েছেন। এদিকে পুলিশের দাবি, বিহারিরা ক্ষুব্ধ হয়ে মোহাম্মদপুর থানার একটি গাড়ি ভাঙচুর করেছেন। তারা সেই গাড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলেও দাবি করে পুলিশ।
এ বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘সংঘর্ষে বিহারিরা পুলিশের ওপর ইট ছোড়েন। এতে পুলিশের ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য আহত হন। তাদের সবার পায়ে ইটের আঘাত রয়েছে। ক্যাম্পের প্রায় ৩১ কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বাকি রয়েছে। তারা বিদ্যুৎ বিল দেবেন না বলে রাস্তায় আন্দোলন চালান।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘স্থানীয় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান তাদের বোঝাতে গেলে তাকেই মারধর করেন বিহারিরা। পুলিশ তাকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে। এছাড়া বিহারিরা মোহাম্মদপুর থানার একটি গাড়িও ভাঙচুর করেছেন। আমরা এখন অভিযান চালাচ্ছি। যারা হামলা চালিয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সাতজন বিহারিকে আটক করা হয়েছে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এসআরজিআরসির সাধারণ সম্পাদক এম. শওকত আলী বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পসহ বাংলাদেশের সব রিফিউজি ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল জাতিসংঘ দিয়ে আসছিল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকা পাওয়ার ডিপিডিসিকে এই বিদ্যুৎ বিল দিতো জাতিসংঘ।’
কাউন্সিলরের ওপর হামলার বিষয়ে এম. শওকত আলী বলেন, ‘স্থানীয় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানকে আমরা ভোট দিয়েছি। তিনি আমাদের প্রতিনিধি। তিনি আমাদের সহযোগিতার জন্যই ক্যাম্পে এসেছিলেন। কিন্তু একটি মহল সেখানে কাউন্সিলরের ওপর হামলা চালায়। কোনও বিহারি হামলা করেননি। ওই মহলটি পুলিশের ওপর হামলা ও ইট ছুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের দাবি নিয়ে বসেছিলাম।’
মোহাম্মদপুর থানায় একাধিক মামলা
পুলিশের কাজে বাধা, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, যানমালের ক্ষতি ও জননিরাপত্তা বিঘ্ন করার অপরাধে মোহাম্মদপুর থানায় একাধিক মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) সিবলী নোমান। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ১২ জনকে আটক করা হয়েছে। আমরা ক্যাম্পে আরও অভিযান চালাবো।’ এরপরই আসামির সংখ্যার বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন বলেও তিনি জানান।