X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

বুয়েটে রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছে না ছাত্র সংগঠনগুলো

রাফসান জানি ও সিরাজুল ইসলাম রুবেল
১২ অক্টোবর ২০১৯, ০৩:৩৫আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:৩৪
image

বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে গত ৬ অক্টোবর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে নিহত আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বুয়েটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, এরমধ্যে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য।

ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা বলছেন, বুয়েটের এই সিদ্ধান্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বাস্তবায়ন করা হলেও আদতে এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে দ্বিগুণ। বিশেষ করে ক্যাম্পাসে উগ্র ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ও হিজবুত-তাহরীর-শিবিরের মতো সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দেবে।
কোনও কোনও সংগঠনের নেতারা বলছেন, বুয়েটে ছাত্রদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য ছাত্রলীগের গত ১২ বছরের আচরণই দায়ী। প্রতিষ্ঠানের হলে-হলে ছাত্রলীগের নেতাদের টর্চার সেল, ছাত্রদের ওপর নির্যাতনসহ নানা কারণেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
আবরার হত্যার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা  বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে মৌলবাদী, জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে৷ এছাড়া প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যাবে৷ যা মোটেও শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণ হবে না।’
সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা কখনও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে ছিলাম না৷ কারণ দেশের সংকট মুহূর্তে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা অনেক।’
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হবে৷ আর এটির জন্য ছাত্রলীগই দায়ী থাকবে৷ কারণ তারাই ক্যাম্পাসগুলোতে দখলদারিত্ব এবং সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি চালু করেছে৷ বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে প্রশাসনের স্বৈরাচারিতা বাড়বে ৷'
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার চালটি একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল উদ্যোগ বলে দাবি করেন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কথিত ছাত্র রাজনীতি বন্ধ আছে সেখানেও প্রকাশ্যে ছাত্রলীগ ও গোপনে ছাত্র শিবিরের তৎপরতা আছে৷ এছাড়া প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র সেখানে প্রবল মাত্রায় চালু থাকবে৷’
আবরার হত্যার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি রাখা না রাখা সেটা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তাদের ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে আমরা পর্যালোচনা না করে কিছু বলতে চাচ্ছি না।’ তিনি মনে করেন, সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে এর ভুলত্রুটি থাকলে তা শুধরে নিয়ে সঠিক পথে আনা যায়।
সনজিত চন্দ্রের দাবি, ছাত্রলীগ মুক্ত চিন্তার চর্চা করে।
প্রসঙ্গত, গত ৬ অক্টোবর রবিবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়ার জের ধরে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে রাতে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরে বাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যার বিচার চেয়ে ইতোমধ্যে বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থীদের অ্যালামনাই সংগঠন ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করে। যদিও আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে ছাত্রদল, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। তারা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। ফাঁকে সারাদেশে ঝটিকা মিছিলে মাঠ গরম করেছে ছাত্র শিবিরও।
বুয়েটের রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে এনজিও সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে মৌলবাদীরা সুযোগ নেবে।’
কোনও কোনও রাজনীতিকের ভাষ্য, লেজুড়বৃত্তির কারণেই ছাত্রলীগ সারাদেশে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। লেজুড়বৃত্তি সংগঠন গণফোরাম কোনোদিন চায়নি, এমনটি উল্লেখ করে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘ছাত্র রাজনীতি ‘লেজুড়বৃত্তি’ হওয়ার পরিণাম সারাদেশ ভুগছে।’
সরকারের পক্ষ থেকেও বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধে উৎসাহ দেওয়া হয়নি। গত ৯ অক্টোবর বুধবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বুয়েট কর্তৃপক্ষ চাইলে ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধ করতে পারে, তবে তিনি ছাত্র রাজনীতি বন্ধে অনাগ্রহী। তিনি সেখানে জানান, তার ছাত্র জীবনেও তিনি রাজনীতি করেছেন। ক্যাম্পাসে ছাত্রদের সাংগঠনিক রাজনীতি বন্ধে অতীতে অনীহা দেখা গেছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মধ্যেও। রাজনীতির প্রধান দুই নেত্রী এ বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থানে দীর্ঘদিন ধরেই।
ছাত্র নেতারা অভিযোগ করছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক ছাত্রলীগের পিছু ছাড়েনি। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাঁদা চাওয়ার অভিযোগে সভাপতির পদ গেছে রিজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের, সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান গোলাম রাব্বানী। এই বিতর্ক শেষ না হতেই বুয়েটে আবরার খুন। এতে করে প্রতিষ্ঠানটি ‘রাজনীতি নিষিদ্ধের’ ব্যাপারটি ঘটেছে।

‘আবরার হত্যাকাণ্ডের একটি বড় বিষয়- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ ভারত সফরে করা কয়েকটি চুক্তি নিয়ে। আবরারের এই স্ট্যাটাসটি রাজনৈতিক সচেতনতার কারণেই’, বলছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা সৈকত আরিফ। আবরার হত্যার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা
তিনি বলেন, ‘আবরার যে বিষয়ে কথা বলেছেন, এরপর তাকে ডেকে নেওয়া হয়েছে, এর মানে হচ্ছে, এই দেশের সার্বভৌমত্ব কতটা প্রশ্নের মুখে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সমতাভিত্তিক কোনও মূল্যায়ন না করে একতরফাভাবে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার এই রাজনীতি, আবরার বুঝতে পেরেছিলেন। আর তিনি এ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকেই শেষ করে দিলো। ফলে, দেশের প্রশ্নে ছাত্রলীগের ভূমিকা কোন পর্যায়ে তা বলাবাহুল্য।’
ঢাবির ছাত্রলীগনেতা সনজিত চন্দ্রের মন্তব্য, ‘আমি মনে করি, ভুল ত্রুটি হতে পারে। সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে যদি কোনও ভুল ত্রুটি থাকে সেগুলো পর্যালোচনা করে তা শুধরে সঠিক রাস্তায় নিয়ে আসা যায়। কারণ শূন্যতা থাকলে সেখানে আরও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী, ছাত্র শিবিরের মতো উগ্রবাদীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ‘
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, 'ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার ফলাফল ভয়াবহ হবে৷ ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী এবং গণ্ডাবাহিনীর যে রাজনীতি করে তাকে ছাত্র রাজনীতি বলে না৷ এ গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য সম্পূর্ণ ছাত্রলীগ দায়ী৷ এর প্রতিবাদে আমাদের কর্মসূচি থাকবে৷’
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল) সাধারণ সম্পাদক গৌতম শীল বলেন, 'একটি ছাত্র সংগঠনের অপরাজনীতির জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হবে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়৷ এজন্য অন্য ছাত্র সংগঠনকে কেন ভুগতে হবে৷ আমরা এর প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করবো৷'

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ চায়, তাদের অবস্থান আসলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে৷ তাদের জন্য আমাদের হুঁশিয়ারি রয়েছে৷’

/এসটিএস/এআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
আইপিএল থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল!
আইপিএল থেকে অনির্দিষ্টকালের বিরতি নিয়েছেন ম্যাক্সওয়েল!
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
রাশিয়ায় বন্যা, শত শত ঘরবাড়ি প্লাবিত
রাশিয়ায় বন্যা, শত শত ঘরবাড়ি প্লাবিত
সর্বাধিক পঠিত
কিছু আরব দেশ কেন ইসরায়েলকে সাহায্য করছে?
কিছু আরব দেশ কেন ইসরায়েলকে সাহায্য করছে?
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবেদন শেষ ১৮ এপ্রিল
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবেদন শেষ ১৮ এপ্রিল
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি