X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিজানের দখলদারিত্ব ছিল সবখানেই

শেখ জাহাঙ্গীর আলম
১৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৫:৩৫আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৯, ১০:০২

স্বপ্নপুরী হাউজিং কমপ্লেক্স মোহাম্মদপুরের বাসিন্দাদের মুখে মুখে শোনা যায়, একসময় সড়কের ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করে সিটি করপোরেশনের কাছেই সেগুলো বিক্রি করতেন র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান। সেই মিজান এখন অঢেল সম্পদের মালিক। দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে এসব অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। রবিবার (১৩ অক্টোবর) মোহাম্মদপুরে সরেজমিন অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডে ‘পান্থনীড়’ নামের বাড়িতে পাঁচতলায় ৪-বি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন কাউন্সিলর মিজান। লালমাটিয়ার বি-ব্লকে স্বপ্নপুরী হাউজিং কমপ্লেক্সটি তার। এছাড়াও সামনের মাঠটিও তার দখলে রয়েছে। মোহাম্মদপুর বালুর মাঠ এলাকার মেট্রোপলিটন কো-অপারেটিভ সোসাইটিতেও মিজানের ১০ কাঠার একটি খালি প্লট রয়েছে। সেখানে তার নামে ক্রয় সূত্রে মালিকানার একটি সাইবোর্ডও দেখা গেছে। এছাড়াও নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয়ের পাশেই মিজানের আরও একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়াও গাজীপুরে ৩০-৩৫ কাঠা জমি থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে। শুধু বাড়ি নয়, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে ৩০ কাঠা একটি প্লট দখল করে সেখানে গড়ে তুলেছেন মার্কেট। এর পাশাপাশি মোহাম্মদপুর সমবায় মার্কেট ও জেনেভা ক্যাম্পের টোল মার্কেট দুটিও সম্পূর্ণ তার দখলে। 

লালমাটিয়া ও মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা জানান, মিজানের কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। তবে প্রভাব খাটিয়ে লালমাটিয়া ও মোহাম্মদপুরে অনেক সম্পদ করেছেন। এসব তার অবৈধ টাকায় গড়া সম্পদ। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কেউ যদি বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ করতেন তবে তিনি নানাভাবে নাজেহাল করে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করতেন। চাঁদা না পেলে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিতেন মিজান। 

স্বপ্নপুরী হাউজিং কমপ্লেক্স

এই হাউজিংয়ে তিনটি ছয়তলা ভবন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি ভবন কাউন্সিলর মিজানের। এই হাউজিংয়ে প্রতিটি ভবনে ৩৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে মিজানের একাই ২৫টি ফ্ল্যাট। এখানকার বাসিন্দারা জানান, ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক প্রভাব ও পেশিশক্তির জোরে জায়গাটি দখল করে নেন মিজান। পরে জায়গাটি তিনটি প্লটে ভাগ করে একটি প্লট লুৎফুর রহমান নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অবৈধ টাকায় এই ভবনগুলো নির্মাণ করেছেন বলেও স্থানীয়রা জানান।

জেনেভা ক্যাম্প টোল মার্কেট মোহাম্মদপুর সমবায় মার্কেট দখল

পেশিশক্তির জোরে মোহাম্মদপুরের সমবায় মার্কেটটি কাউন্সিলর মিজান দখল করে নেন। এরপর মার্কেটটিতে সিটি করপোরেশনের নাম ব্যবহার করে আসছিলেন। একটি সমিতির মাধ্যমে পুরো মার্কেটের ১৩৫টি দোকানের ভাড়া এবং বিদ্যুতের কোটি কোটি টাকা ভোগ একাই ভোগ করেন তিনি। সিটি করপোরেশনের নাম ব্যবহার করা হলেও মার্কেটের আয়ের কোনও অংশ পায় না সংস্থাটি।

টোল মার্কেট দখল

মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে জেনেভা ক্যাম্পের টোল মার্কেটে ১৬৪টি দোকান রয়েছে। সিটি করপোরেশনের নাম ব্যবহার করে নিজেকে এই মার্কেটের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবি করতেন কাউন্সিলর মিজান। রাজনৈতিক প্রভাব ও নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর পেশিশক্তির জোরে এই মার্কেটও দখল করে নেন তিনি। সেখানে মোহাম্মদপুর দোকান মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। কমিটির মাধ্যমে মার্কেট থেকে অবৈধভাবে আয় করেন কোটি কোটি টাকা। তার সহযোগীদের কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি বানিয়ে রাখেন। শুধু তাই নয়, জেনেভা ক্যাম্পের ফ্রি বিদ্যুতের লাইন দিয়ে মার্কেটের আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতি দোকানে ১-৪ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল তোলা হয়।

টোল মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, মার্কেটের সভাপতি রহমতুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন ও ক্যাশিয়ার রেজওয়ান মাসিক হারে দোকানপ্রতি এক হাজার, দেড় হাজার, দুই হাজার, ও চার হাজার টাকা তোলেন। মার্কেটে একটি বরফ ফ্যাক্টরি আছে। সেখান থেকে মাসিক ১৫ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল নেওয়া হয়। এছাড়াও দৈনিক দোকান প্রতি ৪০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এই সব টাকা যেত মিজানের কাছে। তবে সমিতি কোনও রশিদ দিত না। 

হিসাব কষে দেখা গেছে, টোল মার্কেট থেকে এক মাসে বিদ্যুৎ বিল বাবদ সাড়ে তিন-চার লাখ টাকা এবং প্রতি দোকান থেকে দৈনিক ৪০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। একদিনে ছয় হাজার ৫৬০ টাকা এবং মাসে এক লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ টাকা। এর সব টাকাই পেতেন মিজান।

ফুটপাতে চাঁদাবাজি

ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে মোহাম্মদপুর, হুমায়ুন রোড, নুরজাহান রোড়, টাউন হল, লালমাটিয়া, সমবায় মার্কেট এলাকার সব ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি করতেন কাউন্সিলর মিজানের অনুসারীরা। ফুটপাতের দোকানিদের কেউ চাঁদা না দিলে তার দোকান তুলে দেওয়া হতো। এছাড়াও সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে কিছুদিন পরপরই ফুটপাত খালি করে দিতেন মিজান। এরপর চাঁদার হার কিছুটা বাড়তো। এভাবেই ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের ফুটপাতের চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করতেন মিজান। এখান থেকে বড় অংকের টাকা তিনি হাতিয়ে নিতেন। 

বিভিন্ন মাঠ ভাড়া দিয়ে উপার্জন   

স্থানীয়দের অভিযোগ, যেকোনও অনুষ্ঠানের জন্য কাউন্সিলর মিজান মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়ার বিভিন্ন স্কুলের মাঠ এবং খেলার মাঠ ভাড়া দিতেন। সেই টাকা তিনি ভোগ করতেন। এছাড়াও লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি বয়েজ স্কুলের মাঠ দখল করে এই কাউন্সিলর কার্যালয় নির্মাণ করেন।

মাদকের হোতা

মোহাম্মদপুর ও জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার মিজানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দৈনিক মাদকের বিভিন্ন স্পট থেকে তার কাছে সেলামি যেত। মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণের জন্য তার একটি বড় গ্রুপও ছিল। শুধু জেনেভা ক্যাম্প থেকে মাসিক ১৫-২০ লাখ টাকা আয় হতো মিজানের। জানা গেছে, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে তাকে সহযোগিতা করতো মুর্তজা, মাছুয়া সাইদ, রেহেনা, পাপিয়া, ইসতিয়াখ, নাদিম ওরফে বেজি নাদিম, পেলু আরমান, আরশাদ, আলমগীর ওরফে উলটা সালাম, মোল্লা আনোয়ার, ঢাকায়া নাদিম, সীমা, নারগিস, ছয়রা, গান্নি, কালী রানী, ছকিনা ও কুলসুম।

মানি লন্ডারিং মামলায় বর্তমানে মিজান সাত দিনের রিমান্ডে আছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মো. মোস্তফা কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে।’  

৩২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসান নুর ইসলাম রাস্টন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুর্নীতি বিরোধী চলমান এই শুদ্ধি অভিযানকে আমি স্বাগত জানাই। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তাদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। আমরা চাই দুর্নীতিমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন একটি দেশ। চলমান এই অভিযানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সেটি বাস্তবায়ন করছেন। এতে দেশ আরও উন্নত হবে।’

 

/এসজেএ/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়