শিশু কিশোরদের বিনোদনের অন্যতম স্থান রাজধানীর শাহবাগের শিশুপার্ক। কিন্তু আধুনিকায়নের জন্য পার্কটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। এর ফলে বিনোদনের কোনও জায়গা পাচ্ছে না নগরীতে বেড়ে ওঠা শিশুরা। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে পার্ক আধুনিকায়নের কথা বলে পার্কটি বন্ধ করে দেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কথা ছিল, চলতি বছরের মধ্যে পার্কের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় এরই মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে নগরবাসীর মধ্যে। পার্কের কর্মকর্তারা জানান, অনেকেই এসে জানতে চান কবে নাগাদ পার্ক চালু হবে। কিন্তু আমরা কোনও উত্তর দিতে পারছি না। পার্কটি চালু হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিটি করপোরেশন বলছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে পার্কের আধুনিকায়ন সম্ভব নয়। এছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ অর্থের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে মন্ত্রণালয় বলছে, প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের মধ্যেই পার্কের উন্নয়ন করতে হবে। তা না হলে সিটি করপোরেশনকেই প্রকল্প নিতে হবে। মূলত এ কারণেই পার্কের উন্নয়ন কাজ আটকে আছে বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।
জানা গেছে, ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশুপার্কের আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। এজন্য ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার টাকার প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদফতরের। শিশুপার্কের আধুনিকায়নের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। প্রকল্পের মোট বরাদ্দ থেকে শিশুপার্কের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৭৩ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এ বরাদ্দ থেকে পার্কের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করতে কনসালটেন্সি ফি বাবদ এক কোটি টাকা এবং পার্কের ফুটপাত উন্নয়ন, পুরানো রাইড ও অবৈধ স্থাপনা অপসারণসহ অন্যান্য কাজে ব্যয় ধরা হয় পাঁচ কোটি টাকা। বাকি ৭৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে ১৩টি ইকুইপমেন্ট ও আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং নির্মাণে। এরই মধ্যে সিটি করপোরেশন পার্কটি বন্ধ করে পুরানো রাইড অপসারণ করেছে। শুরু হয়েছে পার্কিং নির্মাণের কাজ। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ করা অর্থ ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। ফলে থেমে গেছে পার্কটির উন্নয়ন কাজ। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ পর্যন্ত। প্রকল্পের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থছাড় না দেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছে ডিএসসিসি। এ অবস্থায় পার্কটির জন্য সংস্থাটিকে নতুন করে প্রকল্প গ্রহণ করতে হচ্ছে। নতুন প্রকল্প অনুমোদন পেলে পার্কের কাজ নতুন করে চালু হবে। এজন্য আরও কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, পার্কটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে করণীয় জানতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় ডিএসসিসি। মন্ত্রণালয় থেকে ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। পরে ২০১৬ সালের ২৯ জুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে সভায় ডিএসসিসির পক্ষ থেকে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। প্রকল্পে উত্থাপিত বিষয়গুলো থেকে টাওয়ার চ্যালেঞ্জার, টুইন টাওয়ার, রোলার কোস্টার, স্কাই হুইল ও ভাইকিং বাদ দিয়ে পুনরায় প্রকল্প জমা দিতে বলা হয়। এরপর অনুমোদনের আগে ১৫৩ কোটি টাকার প্রকল্প জমা দেয় ডিএসসিসি। ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকল্পটি অনুমোদন পায়।
কিন্তু পার্কের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ- মুভি থিয়েটার, রাইডসের প্ল্যাটফর্ম, ট্রান্সফর্মার, সাবস্টেশন, টিকেট কাউন্টার, শেল্টার সেড, অফিস বিল্ডিং, পাবলিক টয়লেট, স্টোর রুম, সিকিউরিটি রুম, গ্রাউন্ড ফিল্ড ডেভেলপমেন্ট, প্লান্টেশন, বিউটিফিকেশন, সেনেটারি এবং ওয়াটার সাপ্লাই কাজ প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়। এতে বরাদ্দ রাখা হয় ৭৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। যার কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী শিশুপার্কের কাজ করা সম্ভব হয়নি বলে দাবি ডিএসসিসির।
এদিকে পার্কের মাটির নিচে পার্কিং নির্মাণ কাজ শুরু করার ফলে বর্তমানে থাকা অফিস বিল্ডিং, শেল্টার ও রাইড, ফুড কর্নার, টয়লেট, সীমানা প্রাচীর, প্রবেশ গেট, বাইরের গেট ও টিকেট কাউন্টার, গার্ডেন গ্রিল, ঝর্না, আন্ডার গ্রাউন্ড ইলেকট্রিক লাইন, প্ল্যান্টেশন ও বিউটিফিকেশন, ওয়াটার রিজার্ভ ট্যাংক, পানির লাইন, ড্রেনেজ সিস্টেম, ওয়াকওয়ে, বাম্পার কার রাইডস, ট্রালিন বেড রাইডস, ক্যাবল কার রাইডস, ইনডোর গেম, ভাইকিং রাইড, ড্রেনেজ সিস্টেম ও সিকিউরিটি সিস্টেম অপসারণ ও ভেঙে ফেলায় সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। চলমান প্রকল্পে সেই রাইডগুলো অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গত ৭ মে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়।
পার্কের জন্য বরাদ্দ দেওয়া অর্থে পার্কের প্রকল্প পরামর্শকসহ নতুন রাইড সরবরাহ করতে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এতে সর্বনিম্ন দর পড়ে ৩১০ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৭৭ টাকা যা বরাদ্দ অর্থের কয়েকগুণ বেশি। ফলে এই অর্থ সংশোধিত প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হলেও কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
তবে এ বিষয়ে ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন বলেন, ডিএসসিসি যদি সব রাইড অন্তর্ভুক্ত করতে চায় তবে তাদের আলাদাভাবে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। চলমান প্রকল্প থেকে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তিনি বলেন, মূল প্রকল্পে শিশুপার্কের উন্নয়নের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেই অর্থ দিয়েই পার্কের উন্নয়ন কাজ করতে হবে। বরাদ্দ না থাকায় এখানে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমরা সিটি করপোরেশনকে পরামর্শ দিয়েছি- তারা যাতে আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করে।
সম্প্রতি পার্কে ঘুরে দেখা গেছে, পার্কের প্রধান ফটক বন্ধ রয়েছে। ভেতরে চলছে আন্ডার গ্রাউন্ড পার্কিং নির্মাণ কাজ। দায়িত্বরত শ্রমিকরা জানান, অনেক দিন ধরে কাজ বন্ধ। গত বৃহস্পতিবার পার্কের সামনে আরিফুর রহমান নামে একজন অভিভাবককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে বাচ্চাদের এই শিশুপার্কে আনতাম। তারা আনন্দ পেতো। এখনও তারা পার্কে আসতে চায়। কিন্তু গত এক বছর ধরে পার্ক বন্ধ। পার্কের তো কাজই শুরু হয়নি। কবে নাগাদ শুরু হবে তাও বলতে পারছে না।
জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক সার্কেল) ও প্রকল্পের সিটি করপোরেশন অংশের পরিচালক আনিছুর রহমান বলেন, টেন্ডারে অতিরিক্ত দর পাওয়া গেছে। আমরা বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় আমাদের আলাদাভাবে প্রকল্প নিতে বলেছে।