X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

এইচআইভি প্রতিরোধ কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে না কিশোরী যৌনকর্মীরা

জাকিয়া আহমেদ
০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৮:০০আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৮:০০

ছবি: সংগৃহীত সৈয়দপুরের মেয়ে কুহু (ছদ্মনাম, বয়স ১৭)। বাবা-মা, ছয় বোন ও দুই ভাইয়ের সংসারে অভাব ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। বয়স যখন ১৩, তখন পাশের বাড়ির এক ছেলের প্রেমে পড়ে কুহু। এরই মধ্যে একদিন প্রেমিক তাকে বলে, তারা দু’জনে ঢাকায় আসবে, চাকরি করবে, বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারবে। এতে করে ভালো থাকবে তাদের পরিবার। এক রাতে সে প্রেমিকের হাত ধরে সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় পাড়ি জমায়। “বাবাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাবো, ছোট ভাই-বোনগুলো একটু ভালো খেতে পারবে, মাসে অন্তত একটা দিন গোশত দিয়ে ভাত খাবে- এটাই ছিল আমার স্বপ্ন”, মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে এমনটাই জানান কুহু। ‘তবে সে স্বপ্ন আমার মেঘের মতো উড়ে গেছে, বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেছে। এরপর আর নিষিদ্ধপথ থেকে ফিরতে পারিনি।’

কুহু বলেন, যে রাতে ঢাকায় আসি, সে রাতে ওর সঙ্গে গুলিস্তানের এক হোটেলে উঠি। সেখানে সে প্রথমে আমাকে ধর্ষণ করে। এরপর নিচ থেকে আসার কথা বলে হোটেল থেকে পালিয়ে যায়। পরে জানতে পারি, সে আমাকে হোটেলের কাছে বিক্রি করে চলে গেছে….।

সময় নেন কুহু। বলেন, ‘এরপর দেড় বছর ওই হোটেলে ছিলাম। এখন হোটেল ছেড়েছি, কিন্তু যে পেশাতে ঢুকেছিলাম সেখান থেকে আর বের হতে পারিনি, চলে যাচ্ছে জীবন এভাবেই। হয়তো মৃত্যু পর্যন্ত আমাকে এভাবেই জীবন কাটাতে হবে।’

কুহুর মতো দেশে প্রায় ১৮ হাজার কিশোরী বর্তমানে যৌনপেশায় যুক্ত আছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, ভঙ্গুর পরিবার, কম বয়সে বিয়ে হওয়াসহ নানা পরিস্থিতিতে এসব কিশোরী এ পেশায় যুক্ত হন।

নিজে কখনো এইচআইভি টেস্ট করিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে কুহু বলেন, আমরাতো স্বাধীন না, লুকায়ে থাকি। থাকতে বাধ্য হই, তারমধ্যে আবার ডাক্তারি পরীক্ষা। কে করে এত ঝামেলা- বিরক্তি ঝরে পড়ে কুহুর কণ্ঠে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই কিশোরীরা- যারা ঘটনাচক্রে বা দুর্ভাগ্যক্রমে যৌনপেশায় যুক্ত হয়েছে, তারা নানা পরিস্থিতির কারণে নিজেদের লুকিয়ে রাখছে। এতে করে এইচআইভি প্রতিরোধ কার্যক্রমে তাদের সহজে যুক্ত করা যাচ্ছে না। অথচ কিশোরী যৌনকর্মীরা এইচআইভি এইডসের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের এইডস প্রতিরোধে গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়া এই ১৮ হাজার কিশোরীর জন্য সমন্বিত প্রকল্প প্রণয়ন জরুরি।

জানা যায়, ইউনিসেফ বাংলাদেশের অর্থায়নে বর্তমানে সেভ দ্য চিলড্রেন যৌন পেশায় যুক্ত এক হাজার কিশোরীকে নিয়ে কাজ করছে। তাদের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য গত বছরের জুন থেকে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম এবং সিলেট সিটি করপোরেশনে বসবাসকারী এই কিশোরীদের এইচআইভি প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিতে যুক্ত করে অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি সহজ করা হয়। কিশোরীদের জীবন ও মনস্তত্ব, পেশার ঝুঁকি, ভবিষ্যত ভাবনা বিষয়ে তাদের অবস্থান ও অনুভূতি নিয়ে কাজ চলছে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের এইচআইডি/এইডস প্রোগ্রামের চিফ অব পার্টি ডা. লিমা রহমান বলেন, বাংলাদেশে এক লাখ দুই হাজারের মতো যৌনকর্মী রয়েছেন, এর মধ্যে কিশোরী যৌনকর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজারের মতো। এই ১৮ হাজার মেয়ের বেশিরভাগই এইডস প্রতিরোধ কার্যক্রমে আসতো না, তাদের এত জানাবোঝা নেই। এই কর্মসূচিতে ১৮ শতাংশ কিশোরীর অর্ন্তভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে আসছে তিন শতাংশ। অথচ ওরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। তখনই মনে হলো, এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচিতে এদের আনা জরুরি। আবার এমনও আছে, তারা এত ‘হিডেন’ যে তাদেরকে ‘আইডেন্টিফাই’ করা যাচ্ছে না, আর আইডেন্টিফাই করা না গেল তাদেরকে কোনও কর্মসূচির আওতায় আনা যায় না।

আর এ কিশোরীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বেশি, বলেন ডা. লিমা রহমান। এরা ‘সো মাচ অব স্টিগমা অ্যান্ড ভায়োলেন্সের’ শিকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, এজন্য গণসচেতনতা বাড়াতে হবে, বৈষম্য এবং অপবাদ দূর করতে হবে। এইচআইভিকে যদি সহজভাবে না দেখা যায়, তাহলে যৌনপেশায় যুক্ত কিশোরীদের এ কর্মসূচিতে আনা কঠিন হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “এসব কিশোরীরা ‘মোস্টলি’ হিডেন থাকতে চায়, তাদের ‘স্ট্যাটাস’ জানাতে চায় না।” তাই আমরা চেষ্টা করি তাদের সরকারি ড্রপ ইন সেন্টারগুলোতে নিয়ে আসতে। কিন্তু যেহেতু তারা সরাসরি আমাদের কাছে আসবে না, তাই ওদের মধ্যে থেকে ‘পিআর কাউন্সিলর’ নির্বাচন করা হয়। এদের মাধ্যমে অন্যদের এ বিষয়ে সচেতন করার কাজ চলছে।

এইচআইভি মুক্ত না থাকলে ক্ষতিটা নিজের, এটা তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে বলে জানান ডা. সামিউল। তিনি আরও বলেন, যদি কেউ ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তারা যেন নিজের অবস্থানটা জানাতে পারে, সে বিষয়ে তাদের সচেতন হতে হবে। একইসঙ্গে তাদেরকে কনডম ব্যবহার করতে হবে। এটা যেমন এইডস থেকে বাঁচাবে তেমনি অপরিকল্পিত গর্ভধারণ থেকেও তাদের বাঁচতে সহায়তা করবে।

এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচিতে এসব ‘হিডেন’ যৌনকর্মীদের অর্ন্তভুক্ত করা ভীষণভাবে জরুরি উল্লেখ করে বাংলাদেশ এইডস প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল প্রোগামের সাবেক প্রজেক্ট ডিরেক্টর চেয়ারম্যান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অনেকেই আছেন যারা নিজেদের প্রকাশ্যে আনতে চান না, লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হন। কিন্তু যদি তারা এভাবে লুকিয়ে থাকেন, তাহলে এইডস প্রতিরোধ কার্যক্রমে এদের অর্ন্তভুক্ত করা কঠিন হবে। তাই আন্তরিকতা দেখিয়ে তাদের প্রতিরোধ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

 

/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী