X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাবেক প্রধান বিচারপতির ‘আক্ষেপ’

বাহাউদ্দিন ইমরান
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৩:৫৬আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:১৮

সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজ চেম্বারে উপস্থিত ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। শুরুতেই তিনি সাক্ষাৎকারের জন্য নির্ধারিত প্রশ্নগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। এরপর অনুমতি দিলেন সাক্ষাৎকার শুরুর। কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার আগেই আপন মনে বেশ কিছু কথা বলে যেতে থাকলেন বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। তার সেসব কথায় কখনও ছিল আক্ষেপ, আবার কখনও অভিযোগের সুর। তিনি বললেন, ‘ফেব্রুয়ারি এলেই বরাবরের মতো এই একই বিষয়ে আমাকে বহুবার উত্তর দিতে হয়, দিয়েছি। আবারও আপনারা সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই এসেছেন। কিন্তু আগস্ট মাসেও আসেন না বা অন্য কোনও মাসেও আসেন না। ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের মনে হয়, বাংলা ভাষা আছে একটা এবং বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু কাজ করা উচিত।’ 

কথাগুলো শেষ হতেই নির্ধারিত প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে শুরু করলেন তিনি।

প্রশ্ন: কোন প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে বাংলাতে রায় লেখা শুরু করেছিলেন?

এবিএম খায়রুল হক: বাংলায় রায় লেখা শুরু করি ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষার প্রতি নিজের ভালোবাসা থেকেই বাংলায় রায় লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। তখন আমি হাইকোর্টের একটি রিট বেঞ্চের দায়িত্বে ছিলাম। তবে হঠাৎ করেই নয়, বহুদিন ধরেই মনে করেছিলাম বাংলা ভাষায় রায় দেওয়া উচিত, রায় দবো ইত্যাদি। তবে চিন্তা করলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারছিলাম না এই কারণে যে, তখন আমাদের হাইকোর্টের রুলসে (বিধিতে) বলা ছিল, হাইকোর্টের ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। অন্যদিকে আমাদের সংবিধান বলে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তখন দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় পরপর তিন দিন বিচারপতি এমএইচ রহমানের তিনটি আর্টিকেল বেরিয়েছিল। ওখানে তিনি বাংলা ভাষায় যে আমাদের রায় দেওয়া উচিত, সে বিষয়গুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন। তখন ওই আর্টিকেল পড়ে নিজেও সাহস পেলাম। আর যেহেতু সংবিধান সর্বোচ্চ আইন, সেহেতু সেখান থেকেই বাংলাতে রায় লেখা শুরু করেছিলাম। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক

প্রশ্ন: হাইকোর্টের রুলসের ইংরেজি ভাষার সঙ্গে সংবিধানের ভাষার ব্যবহারে সাংঘর্ষিক ছিল কিনা?

এবিএম খায়রুল হক: পরবর্তিতে একটি রুল কমিটি করা হয়েছিল। এক পর্যায়ে আমি ওই কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলাম। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই, রুলসে ‘বাংলা’ যুক্ত করার। রুলসে যেহেতু সববিষয় থাকে না, তাই ওই কমিটি থেকে হাইকোর্টের রুলসের ভাষা ইংরেজির সঙ্গে ‘বাংলায়’ কথাটি যুক্ত করা এবং ইংল্যান্ডের মতো করে আমাদের দেশের প্রধান বিচারপতিদের রুলস তৈরির ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধি সংযোজন করেছিলাম। পরে ২০১২ সালে এই রুলস পাস হয়। যার ফলে বাংলা ভাষায় রায় দিতে এখন আর কারও কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। তবুও কিছু সমস্যা হয়। কারণ, বাংলায় আইনের প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। আইনগুলো ব্রিটিশ আমলের। সেখান থেকে হাজার হাজার রায় ও সিদ্ধান্ত এসেছে ইংরেজিতে। তাই কিছু ইংরেজির মর্মার্থ বাংলায় প্রতিশব্দ করা ছিল বেশ দূরূহ কাজ। আমার আগেও বিচারপতি এআরএম আমিরুল ইসলাম আশির দশকের শেষ দিক থেকে রায় ও আদেশ বাংলায় দেওয়া শুরু করেছিলেন। তাকেই মূলত বাংলা রায়ের পথিকৃৎ বলা চলে।

প্রশ্ন: আইনের বিষয়ে বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজতে আইন কমিশন কোনও ভূমিকা রেখেছে?

এবিএম খায়রুল হক: অনেক আগেই বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং আমাদের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ২০০৬ সালে বাংলায় একটি আইন শব্দকোষ তৈরি করেন। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত ছিলো না। তাই বিচারিক জীবন শেষে আইন কমিশনে আসার পর আমি বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করি। এরপর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে নিয়ে আমরা পুনরায় গবেষণা শুরু করি। নতুন আইন শব্দকোষে পূর্বেরটিসহ প্রায় সাড়ে ১০ হাজার শব্দ অন্তর্ভুক্ত করি। আগামী মার্চ মাসে এটি বাজারে আসবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির মোড়ক উন্মোচন করতে সম্মতি প্রকাশ করেছেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আইন শব্দকোষটি শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করা হবে।  সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক

প্রশ্ন: আপনার সময়ে অন্য বিচারপতিরাও বাংলায় রায় লিখতেন?

এবিএম খায়রুল হক: সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসহ প্রায় ৫ থেকে ৭ শতাধিক রায় ও আদেশ আমি বাংলাতেই দিয়েছি। তবে সে সময়ে অনেকেই বাংলায় রায় লিখতে অনিহা প্রকাশ করতেন। আমার সঙ্গে যারা বসতেন, তাদের আমি বাংলায় রায় লিখতে উৎসাহ দিতাম। আপিল বিভাগের বিচারপতি হওয়ার পর বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনকে বাংলায় রায় দিতে উৎসাহ যোগাই। পরবর্তীতে তিনি বাংলায় রায় লেখা চালু রাখেন। এছাড়াও বিচারপতি আশরাফুল কামাল, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকীও বাংলায় রায় লিখছেন। এটা আমার জন্য সন্তোষজনক।

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও দেশের দাফতরিক ভাষা বাংলা করার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে নির্দেশনা কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে?

এবিএম খায়রুল হক: বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছিলেন। কারণ আমরা বাঙালি জাতি। তাই এখানে সবকিছু বাংলাতেই হওয়া উচিত। চিত্ত রঞ্জন দত্ত, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বাংলাকে ভালোবেসে অনেক কথাই বলেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে চালু করতে বঙ্গবন্ধু বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে আইন, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল অঙ্গনগুলোতে বাংলা ভাষায় তেমন কোনও বই নেই। ধীরে ধীরে এগুলো পরিবর্তন করতে হবে, পরিবর্তন হতেই হবে।

আমরা বাংলার মাঝে মাঝে ইংরেজিতে কথা বলাকে আভিজাত্য মনে করি। কিন্তু এটা ভেইন গ্লোরি (দম্ভের), এটা ঠিক না। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের ভাষা হিসাবে ইংরেজি শিখতে হবে ঠিকই, তবে অবশ্যই বাংলা ভাষা আগে শিখে তবেই অন্য ভাষা শিখতে হবে।

প্রশ্ন: বাংলায় রায় লেখা নিয়ে আইন কমিশনের সুপারিশমালা কতটুকু কার্যকর হতে পেরেছে?

এবিএম খায়রুল হক: কমিশনের সুপারিশ অনুসারে নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রায় সবাই বাংলায় রায় ও আদেশ লিখছেন। হাইকোর্টেরও অনেক বিচারক বাংলা রায় লিখছেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বাংলায় রায় লেখা হচ্ছে বলে জানা নেই।

প্রশ্ন: বাংলায় রায় লেখা নিয়ে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জন্য আপনার কোনও পরামর্শ রয়েছে?

এবিএম খায়রুল হক:: অনেকেই বলেন বাংলায় রায় লেখা কষ্টসাধ্য। আসলেই অনেক কষ্টের। শুরুর দিকে আমি নিজেও কষ্ট করে বাংলায় রায় দিয়েছি। কিন্তু পরেরদিকে আর সমস্যা হয়নি। প্রথম প্রথম চেষ্টা করলে যে কোনও বিষয় কষ্টকর মনে হয়। তবে সবাইকে বাংলায় রায় লেখার ইচ্ছা থাকতে হবে। ধাক্কা খেতে খেতে শিখতে হবে।

প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।

এবিএম খায়রুল হক: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম।

 

 

/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বাধিক পঠিত
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ