X
মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারি হাসপাতালের ফটকে ঝুলছে ‘ক্লোজ’

জাকিয়া আহমেদ
০৪ এপ্রিল ২০২০, ০২:৩৩আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৩৪

প্রবেশপথে লেখা ‘ক্লোজ’ ৬৭ বছরের নাজমা বেগম ক্যানসারে আক্রান্ত। পেটে পানি জমার কারণে চিকিৎসক তাকে আলট্রাসাউন্ড করতে বলেন গত ২৪ মার্চ। সেদিন থেকে অনেক হাসপাতাল ঘুরে পরিচিতজনের সুবাদে অবশেষে তার আলট্রাসাউন্ড হয়েছে গত ২ এপ্রিল। তার মতো অনেক রোগীই বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারাত্মক সংকটে পড়ছেন। মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন রোগীর স্বজনরা। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, আগের মতো চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে না। সেজন্য অধিকাংশ হাসপাতালই রোগীশূন্য। রোগীদের প্রবেশেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কোথাও লেখা রয়েছে ‘ক্লোজ’। ঘোষণা না থাকলেও কার্যত বন্ধই রয়েছে এসব হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।     

রোগী নাজমা বেগমের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসক আলট্রাসাউন্ড করার জন্য বলার পর থেকেই ছয়টি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিই। কিন্তু তারা বলেছেন, কেবলমাত্র ইমার্জেন্সি সার্ভিস রয়েছে, কোনও টেস্ট করানো হবে না।’ অবশেষে বন্ধু থাকার কারণে সাত নম্বর হাসপাতালে গিয়ে মায়ের আলট্রাসাউন্ড করাতে পেরেছেন জান্নাতুল।

জান্নাতুল বলেন, ‘পেট থেকে পাঁচ লিটারের মতো পানি বের করা হয়েছে। কী কষ্টটাই করেছে! উঠতে পারে না, বসতে পারে না, কেবল একটু আল্ট্রাসাউন্ডের জন্য।’

যে বেসরকারি হাসপাতালে মাকে নিয়ে তিন দিন ছিলেন জান্নাতুল সেখানকার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বড় কোনও ডাক্তারই হাসপাতালে আসেন না। অন রিকোয়েস্টে কেবলমাত্র গাইনি বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক আসেন সিজারিয়ান কেস হ্যান্ডেল করতে। বাকিরা কেউ আসছেন না। কেবলমাত্র আইসিইউয়ের রোগীদের রাখা হয়েছে। পুরো হাসপাতাল জুড়ে সুনসান। কেউ নেই।’

ভিজিটর পাস ছাড়া হাসপাতালে প্রবেশ ও অবস্থান নিষেধ তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে ভর্তি রোগী ছাড়া কারও আলট্রাসাউন্ড করা হবে না। একটি হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, যদি ডাক্তার আসে তাহলে পারবো, নয়তো সম্ভব না।’

এদিকে, বেসরকারি চাকরিজীবী আতিয়া অর্পার দাদুর বয়স ছিল ৭৯ বছর। কিডনি আর হার্টের সমস্যা ছিল। গত ২২ মার্চ সারাদিন তিনটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে চার নম্বরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে (ডিপার্টমেন্টের প্রধান করোনা হয়নি নিশ্চিত করার পর ভর্তি নেওয়া হয়)। এরপর অবস্থার অবনতি দেখে রাত ১২টায় জানিয়ে দেয় তারাও রাখতে পারবে না, এরপর ৫ নম্বর হাসপাতালে নিয়ে মধ্যরাতে ভর্তি। ভোরে অবস্থার অবনতি।এরপর লাইফ সাপোর্ট।  অতঃপর সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে মারা যান লুৎফুন্নাহার।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি নিচ্ছে না, চিকিৎসকরা বসছেন না– এমন অভিযোগ রোগী এবং স্বজনদের। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ এপ্রিল রাজধানীর পান্থপথ, গ্রিন রোড ঘুরে দেখা যায়– যে গ্রিন রোডে পা ফেলার জায়গা থাকে না। ডাক্তারের সিরিয়াল সন্ধ্যা ৭টায় থাকলে মগবাজার থেকে বের হতে হয় সাড়ে ৪টায়। সেই গ্রিন রোডে কোথাও কেউ নেই। হাসপাতালের সামনে নেই নিরাপত্তারক্ষীদের হুইসেল, নেই গাড়ির জটলা।

গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে তালা মারা। ভেতর থেকে সাইনবোর্ড ঝুলছে ‘ক্লোজ’। ভেতরে তিনটি লিফটের সিরিয়ালে জায়গা পেতে যেখানে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। কয়েকবার লিফট উপর-নিচ করার পর সুযোগ হয় ওঠার। সেই লিফটের কয়েক হাত দূর থেকে লেখা ‘ভিজিটর পাস ছাড়া হসপিটালে প্রবেশ ও অবস্থান নিষেধ’। রিসেপশনের সামনে যেখানে রোগীদের দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে চেয়ারগুলো শূন্য পড়ে আছে। রিসেপশনের চারপাশে পর্যন্ত আটকে দেওয়া হয়েছে। সব ফাঁকা কেন জানতে চাইলে রিসিপশন থেকে বলা হয়, স্যাররা ছুটিতে আছেন।

তালাবদ্ধ এ হাসপাতালের বিপরীত দিকে অবস্থিত সেন্ট্রাল হাসপাতাল। সেখানে গিয়ে দিয়ে যায়, ভেতরের মূল ফটকের তিন-চতুর্থাংশ আটকানো। ওয়েটিং জোনে কেবল খালি চেয়ার। মধ্যবিত্তের আস্থার এ ‍পুরনো হাসপাতালটিতে যেখানে গা ঘেঁষে দিয়ে চলতে হয় রোগীদের সেখান প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করেও একজন রোগীর দেখা মিললো না।

একটু এগিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতাল। অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজির ভিড়ে যেখানে রোগী নামাতে একটু দেরি হলেই নিরাপত্তারক্ষীদের লাল চোখ দেখতে হয়, সেই হাসপাতালের সামনে দুটি অ্যাম্বুলেন্স আর দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অলস সময়ে রাস্তার ধারে চা খেতে দেখা যায় নিরাপত্তারক্ষীদের।

বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগী নেই। এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা মিলছে না বলে তারা অভিযোগ পাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ক্লিনিক এবং প্রাইভেট চেম্বারগুলো অনেকাংশে বন্ধ আছে। এই সময় পিছপা হওয়াটা যুক্তসঙ্গত নয় মন্তব্য করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমরা পিছপা হবো না।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, মূলত রোগীর অভাবেই তাদের হাসপাতালের কার্যক্রম সীমিত হয়েছে।

হাসপাতালে রোগীর ভিড় নেই স্বীকার করে নিয়ে ল্যাবএইড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এমএ শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনার এই দিনে রোগী-চিকিৎসক উভয় পক্ষই ভয় পাচ্ছেন। রোগীও আসছেন না, চিকিৎসকও কমে গেছে।’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘রোগীরা ভয় পাচ্ছেন কোনও করোনা আক্রান্ত থাকলে তার থেকে সংক্রমিত হতে পারেন। তাই পারত পক্ষে কেউ বাসা থেকে আসছেন না। একইসঙ্গে রাস্তা ফাঁকা, পরিবহনের সমস্যাও রয়েছে। অন্যদিকে একজন রোগী করোনা আক্রান্ত কিনা সেটা যেহেতু চিকিৎসক জানতে পারছেন না তাই চিকিৎসকরাও রোগী দেখছেন ভাগ করে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আতঙ্ক কাজ করছে সবার ভেতরেই। তাই হাসপাতালে রোগী কম।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট হসপিটাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেষ্ঠ্য সহসভাপতি ও শমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এবিএম হারুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিটি জরুরি বিভাগই যথাযথভাবে প্রস্তুত, কিন্তু রোগী নেই।’

সেন্ট্রাল হসপিটাল হাসপাতালগুলো তাহলে রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘যতটুকু তাদের ক্যাপাসিটি আছে, ততটুকু দিচ্ছে।’ তাহলে কি কোভিড-১৯-এর আগের অবস্থার মতোই হাসপাতাল চলছে? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আসলে রোগীই তো নেই হাসপাতালে। ৯০ শতাংশ বেডই খালি পড়ে আছে। প্রথম সারির বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার-নার্স-ব্রাদার-টেকনিসিয়ান-অ্যাটেন্ডেন্ট-এভরিথিং ইজ রেডি, কিন্তু দেয়ার ইজ নো পেসেন্ট।’ কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে বলেছেন, হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার পাচ্ছেন না রোগীরা, এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে হাসপাতালের নাম। এভাবে ঢালাওভাবে বলার সুযোগ নেই।’ তাহলে কি হাসপাতাল প্রস্তুত থাকলেও রোগী নেই? প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তা তো অবশ্যই। তবে হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগ বন্ধ।’ পরে স্বীকার করেন তিনি।

এদিকে, চিকিৎসক নেতা ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান হবে শিগগিরই।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা কাজ করছি, সমাধান হয়ে যাবে।’

 

/জেএ/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আমাদের ছাড়াতে এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছিল’
‘আমাদের ছাড়াতে এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছিল’
লিগ্যাল এইড পরিচালনায় অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন প্রধান বিচারপতি
লিগ্যাল এইড পরিচালনায় অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন প্রধান বিচারপতি
ডিআইইউ’তে বুধবার জেএমসি মিডিয়া বাজের পঞ্চম আসর
ডিআইইউ’তে বুধবার জেএমসি মিডিয়া বাজের পঞ্চম আসর
কোহলির রেকর্ড ভেঙে পাকিস্তানকে সিরিজ জেতালেন বাবর
কোহলির রেকর্ড ভেঙে পাকিস্তানকে সিরিজ জেতালেন বাবর
সর্বাধিক পঠিত
শুক্রবারও চলবে মেট্রোরেল
শুক্রবারও চলবে মেট্রোরেল
শেখ হাসিনার তিন গুরুত্বপূর্ণ সফর: প্রস্তুতি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
শেখ হাসিনার তিন গুরুত্বপূর্ণ সফর: প্রস্তুতি নিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
সজনে পাতা খেলে মিলবে এই ১২ উপকারিতা
সজনে পাতা খেলে মিলবে এই ১২ উপকারিতা
রংপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ
রংপুরের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ
সাকিব-তামিমের কারণে দলের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে: ইমরুল 
সাকিব-তামিমের কারণে দলের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে: ইমরুল