১৯৭১ সালে তিনি ১৮ বছর বয়সী তরুণ। পড়ছিলেন ঢাকা শহরের এলিট স্কুল আদমজী ক্যান্ট পাবলিক স্কুলে।যুদ্ধ শুরুর পর পরিবারের প্রত্যেকে যখন বিদেশ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নেন তখন তার পাসপোর্ট ভিসাও ছিল মায়ের হাতে। কিন্তু,পরিবারের সঙ্গে বিদেশের নিরাপদ আয়েসি জীবন বেছে না নিয়ে সবার মত উপেক্ষা করে তিনি চলে গেলেন রনাঙ্গনে।তার ভাষায়,‘পরিবার চলে গেল সুইজারল্যান্ড আর আমি যুদ্ধে’। এই যোদ্ধার নাম আক্কু চৌধুরী।
এই ক্ষ্যাপাটে যোদ্ধা নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেমন পার করেছেন যুদ্ধের সময়টা, তেমন ক্ষ্যাপামো নিয়েই যুদ্ধের পর নেমেছেন মুক্তিযুদ্ধের ধ্রুপদী সময়টাকে সংরক্ষণের আরেক যুদ্ধে। সেই ইতিহাস ও উপাদানগুলো নিয়ে আরও কিছু বন্ধু-সুহৃদের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর—হারিয়ে যেতে বসা মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাস, উপাদান ও উপকরণকে জড়ো করেছেন এক ছাদের তলায়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল বিরোধী চেতনার শাসকেরা তখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে তোলার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করার মহান দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি।সেই কাজ এখনও করে চলেছেন তিনি।মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোতে ঘুরে ঘুরে খনন কাজ করেছেন সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে।
আক্কু চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধার সনদ নেননি কখনও। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কিনা কেউ এমন সন্দেহ করলে স্বভাবসুলভ হেসে বলেন, ‘আমার কোনও সনদ নেই, কেউ আমাকে মুক্তিযোদ্ধা না মানুক, রাজাকারতো বানাতে পারবে না। সেইদিনগুলো কোনভাবেই মিথ্যা করে দিতে পারবে না। এ লড়াই আমার সর্বক্ষণের।’
বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরীর সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের।
১৯৭১ সালে কোথায় ছিলেন?
আমি তখন এইচএসসি পড়ছি। আদমজী ক্যান্ট পাবলিক স্কুলে পড়তাম। বয়েজ স্কুল, আমাদের ক্লাসে ৩০জন ছেলে ছিলাম। তাদের মধ্যে মাত্র তিনজন বাঙালি ছিল। এই থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগের বাংলাদেশের পরিস্থিতি বোঝা যায়। বাঙালির ওপর তখন নির্যাতন নিপীড়ন এবং বৈষম্য চলছিল পুরোদমে। স্কুলটা সেনাবাহিনী চালাতো এবং ভর্তুকি দিতো কেবল নিজেদের ছেলেদের জন্য। আর বাইরে থেকে যারা আসতো তাদের বিশাল খরচ যোগাতে হতো।
তখন আমাদেরকে বাঙালি বন্ধুরা মাওড়া ডাকতো। কারণ আমরা বিদেশিদের স্কুলে পড়তাম। আমরা তখন অনুভব করতাম দুইরকম জাত একসঙ্গে বাস করছি। এরপর ৭০ এর নির্বাচনের পর যা হলো সেটা ইতিহাস। মুশকিল হলো আমরা ইতিহাস পড়ি না, শিখি না, বলি না, জানি না।
৭০ এর নির্বাচনের পরই শুরু হলো অনিশ্চয়তা। কী হতে চলেছে। কী হবে।আমার তখন কী আর বয়স! মোটে ১৮তে পড়েছি। শিশুই বলা যায় কারণ, তখন ছেলেমেয়েরা ত্রিশ বছর পর্যন্ত বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতো। ১৯৭১ সালের মার্চে যখন বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ডাক দিলেন তখন মিছিলে মিটিংয়ে আমি আর আমার বন্ধু মাঠে নেমেছি কিন্তু খুব রাজনৈতিক সচেতন ছিলাম এমন দাবি করবো না। বঙ্গবন্ধু একটা স্বপ্ন নিয়ে সামনে এসেছিলেন। সেই স্বপ্নটা আমরাও দেখতে চেয়েছিলাম।
মার্চ মাসে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের আসল চেহারা বের হয়ে এলো তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধ করতেই হবে। বিশ্বাস করেন, একদিনে বালক থেকে যুবক হয়ে গেছি। ১৯৭১ এর মে থেকে, যখন আমি কুমিল্লা পার হলাম তখনই আমাদের অন্য চেহারা। আমাদের আর পেছনে ফেরার কোনও পথ ছিলো না। আমার পরিবার ইউরোপে চলে গেছে।আমাদের বাসা দখল হয়ে গিয়েছিল আগেই।যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে আমরা পালিয়েছিলাম।এরইমধ্যে মা পাসপোর্ট নিয়ে এলো আমার সামনে। এসে বললেন, এদেশে আর থাকা যাবে না। আমাদের চলে যেতে হবে। আমি বললাম, ‘আমি যেতে পারবো না, আমাকে লড়তে হবে।’ তিনি কিছু বলেননি, আমার সাথে কোনও তর্ক করেননি। শুধু বলেছেন, ঠিক আছে। তারপর পরিবারের সবাই চলে গেল সুইজারল্যাণ্ড আর আমি আমি যুদ্ধে গেলাম।
কোন এলাকায় যুদ্ধ করলেন?
আমরা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছি। আমার সঙ্গে আমার বন্ধু আরিফ ছিল। আমরা মে মাসে ওপারে গেলাম প্রশিক্ষণ নিতে এবং ফিরে এসে সাতক্ষীরা এলাকায় যুদ্ধ শুরু করলাম।
সে এক পাগলামো ছাড়া কিছু না। ভীষণ আবেগ নিয়ে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে মেশিনগানের সামনে দাঁড়ানোর মতো পাগলামো ছিল বলেই মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব হয়েছে।পাহারা দেওয়া, রেকি করা, দিনের পর দিন গোসল নাই, খাওয়া নাই। কিন্তু মনের মধ্যে বল ছিলো, যুদ্ধে জয় হবেই।
যুদ্ধের কোন ঘটনা তাড়া করে আজও?
১৬ ডিসেম্বর যখন বিজয় অর্জন হলো তখন আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় ১৬ তারিখ আত্মসমর্পন করলেও খুলনায় কিন্তু করেছিল ১৭ তারিখ। ক্যাম্পে ওয়েট করছি। আমাদের দলের এক ভাই পেছন ফিরে বসেছিল আর আরেক ভাই ফুলতুরি দিয়ে রাইফেলের নল পরিষ্কার করছিল। উনি ভুলেই গিয়েছিলেন রাইফেলে বুলেট ছিলো। হঠাৎই অসাবধানতাবশত গুলি বের হয়ে ওই ভাইয়ের গায়ে লেগে যায়...। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন তিনি, ‘এটাই মুক্তিযুদ্ধ, কতো ঘটনাই যে ঘটে গেছে। এতোগুলো পাগলাটে মানুষ দেশ বাঁচাতে নেমে পড়েছিল। তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ নেই বললেই চলে, কেবল মনের জোরে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জেতা। ভাবা যায়...!
ফিরে আসার দিনের কথা যদি বলেন?
১৭ তারিখ খুলনায় ঢুকলাম। সেখানে থেকে ২৫ ডিসেম্বর আমি আর আরিফ মিলে আমাদের বন্দুক সাব সেক্টর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন হুদার হাতে জমা দিয়ে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তখন তো রাস্তাঘাট ভাল না, ব্রিজ কাটা, কখনও হেঁটে কখনও ট্রাকে করে কিছু রাস্তা— এভাবে ফিরে আসাদ গেটে নামলাম। সেদিন ২৫ ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের দিন। আসাদ গেটে নামার পরে প্রথম অনুভূতি আমরা কোথায় যাবো, দেশেতো আমাদের দুজনেরই কেউ নেই। তারপর ঠিক করি কাছেই এক বন্ধুর বাসায় যাবো। আসাদ গেটের কাছেই ইমরান নামে এক বন্ধু থাকতো। ওদের বাসার সামনে গিয়ে ওর নাম ধরে চিৎকার দিয়ে ডাকছি, কিন্তু কেউ বের হলো না। আমাদের বন্ধুমহলে ওকে আমরা ঘোড়া বলে ডাকতাম, এরপর সেই নাম ধরে ডাকতেই ইমরান বের হয়ে আসে। পরে শুনেছি, তারা আমাদের গলা শুনতে পেয়েও ভয়ে বের হয়নি, কারণ রাজাকাররা নাম ধরে ধরে ডেকে তখনও তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা তো ঢাকায় ছিলাম না, ফলে আমরা এ বিষয়টিও জানতাম না। এতোদিন পর ইমরানই আমাদের একমাত্র চেনালোক হিসেবে সামনে এল।
এরপর?
আমি বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। ১২ বছর আমেরিকায়। আমি ফিরে ৮৫ সালে কাজ শুরু করলাম। তখন দেশের অবস্থা অন্যরকম। মুক্তিযুদ্ধকে গলা টিপে মারার চেষ্টা সফল হতে চলেছে। যারা যুদ্ধ করেনি তারাই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। জয় বাংলা নাকি বলা যাবে না! কী মুশকিল! কিন্তু, আমি যখন জয় বাংলা বলি তখন আমি আওয়ামী লীগ হয়ে যাই না। এটা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান।
যোদ্ধা হিসেবে কষ্ট পান কখনও?
আমি ১৯৭১ সালেও সেপাই এখনও সেপাই। ভাবতে কষ্ট লাগে আমরা জাতি হিসেবে কোথায় নেমেছি যে একটা গোষ্ঠী আজও সাহস করে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করার। কী জঘন্য! আমাদেরকে সঠিক ইতিহাস জানতে হবে, মানতে হবে।নৈতিকতা এতো ভেঙে পড়েছে আমাদের! পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে যা করতে পারেনি ১৯৭৫ সালে এদেশের মানুষের হাত দিয়ে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে সেটা করে দেখালো। এরপর রাজাকাররা হয়ে গেল রাজা আর আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তাদের সার্টিফিকেট দেখানও জরুরি হয়ে গেল। আমি কোনও সার্টিফিকেট চাই না। আমি কী করেছি না করেছি সেটা দেশ দেখলেই বুঝতে পারবে। এই জাতি জানবে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার চিন্তাটা কিভাবে সফল হলো?
১৯৮৫ সালে ফিরে দেখলাম দৃশ্যপট বদলে গেছে। কেউ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে চাইতো না।একটা সময় আসে যখন আত্মজিজ্ঞাসা তৈরি হয়, নিজের কাছেই নিজেকে জবাব দিতে হয়–কি করছো জীবনে? তুমি দেশের জন্য লড়েছো, তারপর কি? এই আত্মোপলব্ধির সময়টাতে আসাদুজ্জামান নূর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। আমার ভেতরে একটা ভাবনা কাজ করতো মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস ও উপকরণ ঐতিহাসিক দলিল হতে পারে যেগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংগ্রহ করা খুব জরুরি। ভাবনাটা নূর ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করলাম। তিনিও একইরকম ভাবছিলেন। তারপর অনেকবার বসা হয়েছে দু’জনে।একটা সংগ্রহশালা করার কথা হতো। এরপর একে একে আরও অনেকে এলো। একটা সময় আটজন মিলে গেলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। সেসময় শাসকদের ভয়ে এজন্য কেউ বাড়ি ভাড়াও দিতে চাইছিলেন না। শেষে সাহস করে এগিয়ে এলেন মিসেস মজিদ। তিনিই এটা করতে দিলেন। আমাদের লক্ষ্য ছিলো যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করছে, তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দ্বিগুণ জোরালোভাবে নতুন প্রজন্মের সামনে আনা।
এটা করতে গিয়ে আমি নিজে খননকাজ করেছি। ১৯৯৮ সালে নূরী মসজিদে খুলি পাওয়া গেছে জানা গেলো।ওখানে কয়েকটা বধ্যভূমি ছিল। আমি যোগাযোগ করলাম তাদের সঙ্গে।খুলিগুলো নিয়ে আসব, আরও কাজ আছে। আমি এটা করবোই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েই ছুটে গেলাম। তারা প্রথমে এটা করতে না দিলেও পরে অনেক অনুরোধ করে রাজি করানো গেল। সকাল সাতটা থেকে আমি কিছু কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরে সেনাসদস্যরা এসে জানালেন, এভাবে এখানে কাজ করা নিরাপদ না, আমি যেন তাদের কাছে নিয়ামানুযায়ী সাহায্য চেয়ে আবেদন করি, তাহলে তারা আমাকে সহায়তা দিবে। এরপর আর পিছন ফিরতে হয়নি। একে একে বের হলো জল্লাদখানা, পাম্পহাউজ। এসবটা করতেই আমার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো আমাকে শক্তি যুগিয়েছে। পরের প্রজন্মের জন্য কিছু রাখতে তো হবে।
/টিএন/