পরাধীন মাতৃভূমি স্বাধীন করতে ১৯৭১ সালে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় মাস দু’মাস আগে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত আত্মত্যাগে স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া হয়। তিনি হলেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালো রাখতে যারা নিজের জীবন দিয়েছেন সেই তাদের মতো বীরসেনাদের পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। হামিদুর রহমানের বেঁচে থাকা তিন ভাই (হামজুর রহমান, শুকুর আলী, ফজলুর রহমান) ও দুই বোনের (আছিয়া বেগম ও রিজিয়া বেগম) সংসার চলে সম্মানি ভাতার ওপর। পরিবারের ৩ সদস্যের নামে রেশন কার্ড থাকলেও গত ৩/৪ মাস যাবৎ রেশন বন্ধ রয়েছে। জমি বলতে তেমন কিছু নেই।
১৯৪৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চব্বিশ পরগনা জেলার চাপড়া থানার ডুমুরিয়া গ্রামে তা তার জন্ম। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর হামিদুর রহমানের পরিবার যশোরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোর্দ খালিশপুর (বর্তমান হামিদ নগর) গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
১৯৭১ সালে ২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন তিনি। পরে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের দক্ষিণপূর্বে কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই নামকস্থানে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ২৮ অক্টোবর যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন তিনি। ওই সময় এই বীর সৈনিকের লাশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসা গ্রামে এক মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর তার দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ঢাকার মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ পদকপ্রাপ্ত সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে হামিদুর রহমানের বয়স সবচেয়ে কম।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের ভাই হামজুর রহমান জয়দিয়া সরকারি বাওড়ে ‘দক্ষ ফিশারম্যান’ হিসেবে চাকরি করেন। বর্তমানে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে আছেন। অপর দুই ভাই শুকুর আলী ও ফজলুর রহমান কৃষি কাজ করেন। পরিবার চলছে খুঁড়িয়ে।
১৯৮১ সালে তৎকালীণ সরকার ঝিনাইদহ খালিশপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বসতবাড়ি তৈরি করে দেয়। অল্পদিনেই বসবাসের উপযোগিতা হারায় বাড়িটি। বর্তমানে ঘরের ছাদের পলেস্তরা খসে পড়েছে। দেয়ালে ফাটল ধরেছে। দরজা জানালাও গেছে ভেঙে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন পরিবারের সদস্যরা।
খালিশপুর গ্রামের নাম মুখে মুখে পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে হামিদনগর। তবে কাগজে কলমে নয়। পরিবার ও এলাকাবাসীর জোর দাবি, গ্রামটির হামিদনগর নামটি দ্রুত কাগজে কলমেও উঠে আসুক।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে তার গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুর রহমান নামে একটি সরকারি ডিগ্রি কলেজও রয়েছে। ২০০৮ সালের ৯ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় কলেজ আঙিনায় ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান গ্রস্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। জাদুঘরটির সরকারিকরণ এখনও হয়নি।
গ্রন্থাগারিক হিসেবে চাকরি করছেন হামিদুর রহমানের মেজোভাই হামজুর রহমানের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মিলন। তাকে জেলা পরিষদ থেকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তার চাকরির সরকারি হয়নি। সম্প্রতি কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ নিয়েছেন হামিদুর রহমানের বোনের ছেলে মুকুল জোয়ার্দ্দার। তার কোনও বেতন ধার্য হয়নি। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের মা কায়ছুন নেছার কবর।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের ভাইপো হাফিজুর রহমান জানান, সরকারিভাবে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের পাঁচ সদস্যের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫৫৯০ টাকা প্রতিমাসে দেওয়া হয়। এছাড়া ৩ সদস্যেদের নামে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাউল, ৩০ কেজি আটা, ১০ কেজি ডাল, পাঁচ কেজি চিনি, ৮ কেজি তেল রেশন হিসেবে দেওয়া হতো। সম্প্রতি তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মূলত সরকারের দেওয়া সম্মানি ভাতার ওপরই তাদের সংসার চলছে।
সামরিক বাহিনীর দেওয়া মুক্তিযোদ্ধার অস্থায়ী সনদপত্র (প্রভিশনাল সার্টিফিকেট) ছাড়া আর কোনও স্মৃতি চিহ্ন নেই হামিুদর রহমানের বাড়িতে। জাদুঘরে টানানো রয়েছে বিভিন্ন ছবি ও পুস্তক।
হামিদুর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত সরকারি কলেজের ২২ শিক্ষকের চাকরির সরকারিকরণ হয়নি।
বীরশ্রেষ্ঠের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তটি ভেঙে গেছে অসংখ্য জায়গায় খানা-খন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ বহু তদবির সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এদিকে নজর দেয়নি। অথচ বীরশ্রেষ্ঠের গ্রাম হওয়ায় বহু ভিআইপির এখানে আসে।
কথা হয় হামিদুর রহমানের বাল্যবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুঃখ হয় যখন দেখি বীরসেনার গ্রামেরও রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে। বহু মানুষ ইচ্ছা থাকলেও হামিদুরের একমাত্র স্মৃতি তার বসতভিটা দেখতে আসতে পারেন না। ’
হানিফ মন্ডল নামের এক গ্রামবাসী আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘হামিদুরের বসতবাড়ি একেবারেই বসবাসের অযোগ্য। খালিশপুর শহর থেকে সামান্য তিন কিলোমিটার রাস্তার বেহাল দশা। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী প্রতিনিয়ত তার বাড়ি দেখতে আসে। তখন আমাদের লজ্জা পেতে হয়।’
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মকবুল হোসেন বলেন, বিষয়টি যতদ্রুত সম্ভব মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।
মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশাফুর রহমান বলেন, ‘আমি যোগ দেওয়ার পর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি পাঠাগারে রং করিয়েছি। রাস্তাঘাট নিয়েও আমি জেলা মিটিংয়ে বলেছি। এটার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় এমপির অনুকূলে। এমপির ডিও লাগে, সেটি দেওয়া আছে। আমরা আশা করছি এই অর্থবছরে বেশ কিছু কাজ হবে।’
বীরশ্রেষ্ঠের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে হামিদুর রহমানের পরিবারকে দেওয়া স্বর্ণপদকটি লাপাত্তা। সরকারি সূত্র জানায়, বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারকে ১৯৭৪ সালেই স্মারক হিসেবে স্বর্ণপদক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবারের কোনও সদস্যের কাছে তা সংরক্ষিত নেই।
/এইচকে/এসটি/