X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণের ৮০ হাজার কোটি টাকা ফেরত পাবে না ব্যাংক

গোলাম মওলা
২৮ ডিসেম্বর ২০১৫, ১২:৪২আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৩:২১

নিয়ম ভেঙে ঋণ দিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। গত কয়েক বছরে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ আর কখনই ফেরত পাবে না দেশের সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বেহাত হওয়ায় ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থাও বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে এসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

‘মন্দ ঋণ’ বলে অভিহিত এই ৮০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা (পুরাতন খেলাপি) ব্যালান্স শিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আদায় অযোগ্য ঋণ সৃষ্টি হয়েছে আরও প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের অধিকাংশই বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে গেছে বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষক মহল। এর বাইরে কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে আরও ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ঘটনায় ১২টি ব্যাংককে শোকজ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা এক তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঋণখেলাপি ২

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোট খেলাপি ঋণের ৮০ শতাংশের বেশি আদায় অযোগ্য ঋণ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ বা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আদায় অযোগ্য ঋণ। ডিসেম্বর প্রান্তিকে মন্দ ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ার আশংকা করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এদিকে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর আয় দিন দিন কমে যাচ্ছে। কারণ এসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের নিট আয়ও কমে যাচ্ছে।

দেশের অর্থনীতিবিদরাও বলেছেন, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত না পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার পাশাপাশি আর্থিক খাতে অনেকটা বিশৃংখলা তৈরি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়ার কারণে আর্থিক খাতে কিছুটা বিশৃংখলা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, সব চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত না পাওয়ার কারণে ঋণের সুদের হার কমানো যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ এতো বেশি না হলে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেওয়া যেত বলেও মনে করেন অর্থনীতির এই গবেষক। তিনি মনে করেন, ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে থাকলে ঋণে সুদের হার অন্তত ২ থেকে ৩ শতাংশ কমে যেত। এর ফলে দেশে বিনিয়োগও বেড়ে যেত। দেশের অর্থনীতির চেহারাই হয়ত অন্য রকম হতো। ব্যাংক থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা না হলে ব্যাংকের এই টাকা দিয়ে অন্তত দুইটিরও বেশি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত বলেও মনে করেন ড. জায়েদ বখত। তার ভাষায়, এই ৮০ হাজার কোটি টাকা সরাসরি জাতীয় অর্থনীতিতে যদি যোগ হতো তাহলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অন্তত আরও এক শতাংশ বেড়ে যেত।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঋণগ্রহীতারা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যতোটা আন্তরিকতা দেখায় ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে তা দেখায় না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। তিনি বলেন, ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতার বড়ই দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণ বাড়ছে। প্রভাবশালীদের অনেকে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেন না। আবার কিছু অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা জালিয়াতির মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়েছেন। যারা ফেরত না দেওয়ার জন্য ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছে তারা হয়ত দেশেই নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নামসর্বস্ব সহস্রাধিক কোম্পানিকে বড় বড় কোম্পানি দেখিয়ে ঋণ দিয়েছে অনেক ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র মর্টগেজ হিসেবে জমা নিয়েও মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে বড় বড় ঋণ মঞ্জুর করেছেন ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তারা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালকরাও এ ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িয়েছেন নিজেকে।

ড. জায়েদ বখত মনে করেন, অনিয়ম ও জালিয়াতি করে নেওয়া সব ঋণই এক সময় খেলাপি হয়ে পড়ে। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সময়ে বড় বড় কিছু ঋণ কেলেংকারির ঘটনা ঘটেছে। যার ফলশ্রুতিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।

তার দৃষ্টিতে, শুধু ঋণ কেলেংকারির কারণেই খেলাপি বেড়েছে এমনটি নয়, অন্য কারণেও খেলাপি বাড়তে পারে। যেমন- অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে পড়ার কারণেও খেলাপি হতে পারে। অনেক সময় উদ্যোক্তা মৃত্যুবরণ করলে বা পারিবারিক কারণেও খেলাপি হতে পারে। তবে যারা বড় বড় অংকের (বেশি পরিমাণ) ঋণ নিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। এই ধরনের খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

সূত্র মতে, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংক থেকেই গত পাঁচ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণ অর্থ লোপাট করা হয়েছে। আর এইসব অর্থ লোপাটকারী অধিকাংশই দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশ-বিদেশে। আবার কেউ কেউ ব্যাংকের টাকা দিয়ে বিদেশে বাড়ি, ফ্ল্যাট বা জমির মালিকও হয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের তদন্তে দেখা গেছে, ঋণ জালিয়াতি ছাড়াও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংক মিলে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এসব টাকা পাচার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমেই সোনালী ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেহাত হয়েছে। বেসিক ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে আরও সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বিসমিল্লাহ গ্রুপ আত্মসাৎ করেছে আরও এক হাজার দুইশ’ কোটি টাকা। আরও কয়েক হাজার ছোট বড় প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করে নিয়েছে। এসব ঋণের টাকা আদায় করতে না পেরে তাদের খেলাপি ঘোষণা করেছে ব্যাংক। তবে খেলাপি ঘোষণার পরও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি, বরং তা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ায় ব্যাংক যখন গ্রাহকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে তারপরই ঋণখেলাপি প্রভাবশালী ব্যক্তিরা উচ্চ আদালতে রিট ঠুকে দিয়েছেন। এমন অবস্থায় মামলাও দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না, আবার এই বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধারও করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী- চার হাজার ২৫০টি রিটের বিপরীতে আটকে আছে ব্যাংকের ৪৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এগুলোর সবই ঘটেছে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে।

/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বেতন স্কেল ৯৩০০-২২৪৯০ টাকা
সরকারি চাকরির বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বেতন স্কেল ৯৩০০-২২৪৯০ টাকা
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
দুই ভাইয়ের হাতাহাতিতে প্রাণ গেলো বড় ভাইয়ের
দুই ভাইয়ের হাতাহাতিতে প্রাণ গেলো বড় ভাইয়ের
বিখ্যাত চমচমের কারিগর শংকর সাহা মারা গেছেন
বিখ্যাত চমচমের কারিগর শংকর সাহা মারা গেছেন
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট
তৃতীয় ধাপে যেসব উপজেলায় ভোট