X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

করোনার সরকারি রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে এভার কেয়ার হাসপাতালের ‘ঔদ্ধত্য’

জাকিয়া আহমেদ
০৩ নভেম্বর ২০২০, ২৩:০৪আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১৯:০৬

করোনার সরকারি রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে এভার কেয়ার হাসপাতালের ‘ঔদ্ধত্য’ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শাহীন কাউসারের স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত ২০১৩ সাল থেকে। তিনি ‘লাস্ট স্টেজে’ আছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। তাকে ২১ দিন পর পর কেমোথেরাপি নিতে হয়। তিনি রাজধানীর পান্থপথের একটি হাসপাতালে কেমো নিতেন এতদিন। কিন্তু চিকিৎসক বদলানোর কারণে তাকে এভার কেয়ার (সাবেক অ্যাপেলো) হাসপাতালে কেমো নিতে হচ্ছে।

কিন্তু মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) এভার কেয়ার হাসপাতালে কেমো নিতে গেলে এক অমানবিক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাকে। সকাল নয়টায় তার কেমোর সময় নির্ধারিত থাকলেও তাকে এজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বিকাল তিনটা পর্যন্ত। শাহীন কাউসার বলেন, মানুষটা সেখানে গিয়েছে বাঁচার জন্য, যুদ্ধ করছে সে অথচ তারা এই ব্যবহার করেছে। তারা আমাদের বাদই দিয়ে দিয়েছিল, আমার স্ত্রী মানসিকভাবে ভীষণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন, এ অবস্থাতে তাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো, পাবো কিনা কোথাও? সে তো জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে এখন। শাহীন কাউসার বলেন, কেবল আমার জেদের কারণে আজ আমি কেমো দেওয়াতে পেরেছি। কিন্তু সবার তো এই মানসিক শক্তিটা থাকে না, তাহলে তাদের কী অবস্থা হবে।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে শাহীন কাউসার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্ত্রীসহ তিনি এভার কেয়ার হাসপাতালে যান সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার থেকে করা করোনার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কয়ার হাসপাতাল ছাড়া আর কোনও প্রতিষ্ঠানের ফলাফল গ্রহণ করছে না। কিন্তু সরকারি অন্য প্রতিষ্ঠানের ফলাফল কেন নেবে না জানতে চাইলে তারা প্রথমে কোনও যুক্তি দেয়নি। তবে পরে তারা বলে, ৩০ শতাংশ ফলাফল ‘ফেক বা ফলস’ আসে।

শাহীন কাউসার বলেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে সেই ৩০ শতাংশের মধ্যে তো তারাও (এভার কেয়ার) পড়তে পারে, এর নিশ্চয়তা তো কেউ দিতে পারবে না। তাহলে এভার কেয়ার কী করে বলতে পারে তাদের রিপোর্টই শতভাগ নির্ভুল। মূলত আইইডিসিআর বা বিএসএমএমইউতে টেস্ট করতে গেলে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে, আবার আইসিডিডিআর,বিতে এবং স্কয়ারে টেস্ট ফিও বেশ ভালো অঙ্কের। কিন্তু একমাত্র আইইডিসিআর ছাড়া সব জায়গায় আমাকে যেতে হবে, কিন্তু এই লাস্ট স্টেজের মানুষটাকে নিয়ে তো আমি সব জায়গায় যেতে পারি না। তার তো হাঁটতে চলতে কষ্ট হয়, কিন্তু ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার থেকে বাসায় এসে নমুনা নিয়ে গেছে। এই সুবিধা তো আমি অন্য কোথাও পাবো না।

শাহীন কাউসার মঙ্গলবার বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্ধারিত করে দেওয়া এক নম্বরে রয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের নাম। এটা তো সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাহলে কেন তারা এই প্রতিষ্ঠানের ফলাফল নেবে না। এই ইস্যুতে তাদের কোনও প্রপার কোনও ডকুমেন্টস, কোনও পলিসি বা কোনও নির্দেশনাও নাই। এর আগেও কেমো নিতে এসে যুদ্ধ করতে হয়েছে, তখনও তারা আমাকে কোনও লিখিত বা ডকুমেন্টস দেয়নি। এবারও তারা একই কাজ করছে। আমাকে পুরো আড়াই থেকে তিনঘণ্টা এই ফ্লোর থেকে ওই ফ্লোর, এখান থেকে সেখানে গিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাগযুদ্ধ করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে বলেছে, এবারের জন্য তারা আমাকে অ্যালাউ করবে, কিন্তু ফারদার যদি আমি ওই প্রতিষ্ঠান থেকে রিপোর্ট নিয়ে আসি তাহলে তারা আর অ্যালাউ করবে না। পরে আমি তাদের বারবার অনুরোধ করি এ সম্পর্কে তাদের নির্দেশনা দেখানোর জন্য।

শাহীন কাউসার জানান, এর আগে গত ১০ অক্টোবরেও তাদের সঙ্গে এই একই ঘটনা ঘটেছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সেদিন আমাদের ডিজঅ্যালাউ করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। আমরা আমেরিকান অ্যাম্বাসি পর্যন্ত চলে আসি। তখন স্ত্রী আবার বলেন, আরেকবার ফেরত যাই, আর্গুমেন্ট করবো। সেখানে গিয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালককে কল দেই, তাদের এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) ডেটা ওপেন করে চেক দেখে আমাদের অ্যালাউ করেছিল। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এখানে তারা হাসপাতাল চালাচ্ছে, অথচ বাংলাদেশে সরকারের একটি রিপোর্ট তারা গ্রহণ করবে না, এটা কী করে সম্ভব।

সরকার নির্ধারিত কোনও প্রতিষ্ঠানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, কারও কোও ক্ষমতা নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করা মানে সরকারকে অস্বীকার করা, এটা কেবল ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কিছুই নয়—জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ( বিএমএ)-এর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারি হাসপাতালকে অস্বীকার করার কোনও ক্ষমতা কারও নেই। সরকার আপনাকে বেসরকারি পর্যায়ের লাইসেন্স দিছে, আর সরকারি পর্যায়ে যারা কাজ করছে তাদের রিপোর্ট খর্ব করার অধিকার কোনও হাসপাতালের নাই। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট নিতে বাধ্য। ভুক্তভোগী চাইলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। সরকারি হাসপাতালের রিপোর্ট নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়া যায়, প্রতিটি দেশ সরকারি হাসপাতালের রিপোর্টকে ‘রিকগনিশন’ দেয়, সরকারি হাসপাতালের বাইরে তাদের চয়েজ থাকতে পারে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট আপনি গ্রহণ করবেন না—এটা হতেই পারে না। এটা তাদের সাংঘাতিক ঔদ্ধত্য, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বিএমএ’র (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট কেউ যদি ডিজওউন করে দেশের মধ্যে সেটা অন্যায় এবং অন্যায্য। সরকারি প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত করে লোল, আর অমি বললাম ওই প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট আমি বিশ্বাস করি না তাহলে তো রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস থাকে না। রাষ্ট্র যাদের এই বিষয়ে নিবন্ধিত করেছে, অথরাইজড করেছে করোনার পরীক্ষা করার জন্য, তাদের রিপোর্ট যদি কোনও প্রতিষ্ঠান না নেয় তাহলে তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে কী কারণে তারা ওই প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট নিচ্ছে না। আর কেউ যদি কোনও বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করে তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে তাদের কৈফিয়ত তলব করা। এটা ঔদ্ধত্য, রাষ্ট্রের সঙ্গে কেউ এটা করতে পারে না।

তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এভার কেয়ার হাসপাতালের হেড অব মেডিক্যাল সার্ভিসেস ডা. আরিফ মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রোগীর বিষয়টি তো আমি সমাধান করে দিলাম। কিন্তু আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর,বি, বিএসএমএমইউ আর স্কয়ার ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানের করোনার রিপোর্ট নিয়ে গেলে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না বলে যে অভিযোগ এসেছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা আগে ছিল। এখন আমরা সব অ্যাকসেপ্ট করছি।

/জেএ/এমআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে অ্যাস্ট্রা এয়ারওয়েজের চুক্তি সই
ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে অ্যাস্ট্রা এয়ারওয়েজের চুক্তি সই
দেশের উন্নয়নের বিষয়টি বিএনপির সহ্য হচ্ছে না: আইনমন্ত্রী
দেশের উন্নয়নের বিষয়টি বিএনপির সহ্য হচ্ছে না: আইনমন্ত্রী
আরসার বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে যা বললো র‌্যাব
আরসার বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে যা বললো র‌্যাব
‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হবে না’
‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হবে না’
সর্বাধিক পঠিত
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
এডিপি: সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে যে ১০ প্রকল্প
এডিপি: সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে যে ১০ প্রকল্প