দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রায় সময়ই মন্তব্য করছেন। সরকারকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন সময়ে জারি করেছে নানা নির্দেশনা। এর একটি ছিল ঝঁকিপূর্ণ ভবনের সামনে সাইনবোর্ড টাঙানো। কিন্তু বাস্তবে এটিসহ কোনও নির্দেশনাই কার্যকর হয়নি। একটা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সামনেও সাইনবোর্ড টাঙানো হয়নি।
অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা নগরায়নের ফলে ভূমিকম্প তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জীবননাশের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তা রয়েই গেছে। নগরপরিকল্পনাবিদদের মতে, সোমবার ভোর রাতে যে মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, ভবিষ্যতে এর চাইতে একটু বেশি হলেই ঢাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।
জানা গেছে, গত বছর ৩০ এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা কমিটির সভায় বিশেষ রঙ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে সেগুলোতে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ড স্থাপন এবং বিল্ডিং কোড হালনাগাদ করে তা বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থান নিতে রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সভায় সরকারি পুরনো মেডিক্যাল কলেজ ভবনগুলো জরুরিভিত্তিতে পুনঃসংস্কার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মার্কেট ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনার নিরীক্ষা করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরে দুইবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ক মহড়া আয়োজনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে অনুরোধ জানান হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা কমিটির দেওয়া নির্দেশনার আট মাস পেরিয়ে গেলেও রাজউক কিংবা সিটি করপোরেশন কিছু করতে পারেনি। এমনকি ২০১৪ সালের ১৫ জুন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জাতীয় সংসদে যে ৩২১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেগুলোতেও বিশেষ রঙ দিয়ে চিহ্নিতকরণ ও ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ড টাঙানো হয়নি।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্র জানিয়েছে, রাজউক আজ পর্যন্ত ৩২১টি ভবনের বাইরে আর কোনও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে পারেনি। কারণ বিজ্ঞান সম্মতভাবে জরিপ করতে গেলে অনেক অর্থের প্রয়োজন।
রাজধানীতে মাত্র ৩২১টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে রাজউক দাবি করলেও সোমবার সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল জানান, শুধু ঢাকা শহরে ৭২ হাজার বাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন করার জন্য গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে এশিয়া মহাদেশের আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার এলাকাকে ভূমিকম্পপ্রবণ তথা হিমালয়ান ফল্ট থ্রাস্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গত পাঁচ শ’ বছর ধরে এই হিমালয়ান থ্রাস্ট ফল্ট এলাকাতে ঘুরেফিরে ভূমিকম্প হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ও ভুটানে এ পর্যন্ত বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। তাই এ অঞ্চলের ঝুঁকিও অনেক বেশি।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, ১৯৬০ সালের পর ভূমিকম্পের হার বেড়েছে। এ সময় থেকে ঘন ঘন স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প সংঘটন বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আহমেদ আনসারি সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত পাঁচ শ’ বছরের রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হিমালয়ান ফল্ট থ্রাস্টের অন্যান্য দেশে ভূমিকম্প হয়েছে। গত বছর নেপালেও বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এখন বাদ রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও ভুটান। ভূমিকম্পের গতিবিধি পর্যালোচনা করলে ধরেই নেওয়া যায়, বাংলাদেশেও বড় ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।
ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেছেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভবনগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে ঢাকা শহর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আগে থেকেই সরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা নিলে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যেতে পারে।
রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী নগরপরিকল্পনাবিদ মো. এমদাদুল ইসলাম সোমবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকায় বর্তমানে ১০ থেকে ১২ লাখ ভবন আছে। এর বেশির ভাগই যথাযথভাবে নির্মিত হয়নি। আমি মনে করি ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ৭২ হাজার নয়, আরও বেশি। তিনি বলেন, সোমবার ভোরে মনিপুরে সংঘটিত ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬.৭। কিন্তু ঢাকায় আঘাত করেছে ৪ মাত্রায়। যদি কখনও ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে ঢাকা ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এখনই বিজ্ঞানসম্মতভাবে জরিপ চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ন, নাজুক দালান-কোঠা এবং অত্যধিক জনসংখ্যা ভূমিকম্পে ক্ষয়-ক্ষতির সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। তিনি বলেন, ভূমিকম্প সহায়ক ভবন নির্মাণে সরকার বিএনবিসি নামের একটি নীতিমালা প্রণয়ন করলেও সেটা কেউ মানছেন না।
প্রসঙ্গত: গত বছর অক্টোবরে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে হিন্দুকুশ অঞ্চলে পাকিস্তান-তাজিকিস্তান সীমান্তের কাছে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। এর আগে একই বছর ২৫ এপ্রিল ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় নেপাল। প্রায় সাড়ে সাত শ’ কিলোমিটার দূরে সংঘটিত এই ভূমিকম্প বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতেও আঘাত হানে। আবহাওয়া অধিদফতরের মতে, বাংলাদেশে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫।
/ওএফ/এমএসএম/ এএইচ /
আপ: /বিএ/