গণতন্ত্র ও ধর্ম দিনে-দিনে অধিবিদ্যার মতো দুর্জ্ঞেয় হয়ে উঠছে। এর পেছনে কী-কী কারণ উপস্থিত থাকতে পারে, তা হয়ত ব্যাখ্যা করে চালচিত্র তুলে ধরার অনেকে আছেন। আমজনতার তাতে আগ্রহ কতটা ইতিবাচক, তা হলফ করে বলা কঠিন। যে যত কিসিমের ডেফিনেশন ও এর ব্যাখ্যা দিক না কেন, তা মানুষের কল্যাণে কতটা ফলপ্রসূ, এর কোনওটাই মানুষের, মানে আমজনতার কল্যাণের জন্য, আর কতটা অর্থপূর্ণ, বলা মুশকিল।
স্বাধীনতার এত বছর পরও সত্যিকার অর্থে কি সাধারণ মানুষ স্বাধীনভাবে দু’পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে নিজের মতো করে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে? এর পক্ষে কতজন ইতিবাচক সাড়া দেবেন, তা প্রশ্নবোধক। কিন্তু অতি অনুতাপের বিষয়, এমনটা কেউ চাননি, কিংবা প্রত্যাশা করেননি। আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের দাঁড়ানোর ভিত কতটা দৃঢ়, শক্তিশালি হওয়া দরকার ছিল তা কারও বুঝিয়ে বলার আছে কি না? জবাবে বলব, অবশ্যই নয়। এ নিয়ে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট মানুষদের কাছে থেকে ১৭ রকমের কথা শোনা যাবে, যা বায়বীয়। আর ধর্ম সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ঘনিষ্ট ও এর বাইরে মানুষদের কাছে থেকে অকাল্পনিক বিবরণ ও উপদেশাবলি শুনলে মনে হবে তাদের ক্ষমতায় না-বসিয়ে সাধারণ মানুষ কতটা না ভুল করেছে। আসলে কি তাই? ভারত থেকে দ্বিখণ্ডিত হয়ে পাকিস্থান কী-কী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, তাদের স্বধর্মীয় মানুষের ওপর। তাদের হীন কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে তারা কিভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছিল, তা বোধহয় কারও বুঝিয়ে বলা নিষ্প্রয়োজন। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে জামায়াতের কথা বলি কিংবা ধর্মকে আশ্রিত অন্যান্য দলের কথা বলি না কেন, তা কতটা সাধারণ মানুষ সমর্থন করে, যেখানে ৯৫% মানুষ বাংলাদেশে মুসলমান, সেখানে এ সব দলকে সমর্থন করে কতজন মুসলমান, তা খুবই বেদনার বিষয়। ধর্মের একটু হেরফের যেখানে প্রতিটি বাংলাদেশের মানুষ অন্যান্য দেশের মুসলমানদের প্রতি একাত্মবোধ করে, তাহলে এসব দলকে প্রতিটি মানুষ দলে দলে যোগ দেয় না কেন? পর্দার পেছনের কারণ কী, তা স্পষ্ট। বিশ্বাসহীনতা, কপটতা, চতুরতা ও নিষ্ঠুরতা। গণতন্ত্রধর্মী দলগুলোয় তা নেই তা হলফ করে বলা যাবে না। তবে এটা সত্য মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে রাজনীতি করলে সেটা কখনও জনসমর্থন পায় না; আর পাবেও না। সাধারণ মানুষ এটা বোঝে যে, কে তাদের ভালোবাসে, কে তাদের আপনজন। ভাসানী কিংবা বঙ্গবন্ধু মানুষকে ভালোবাসতেন; তাই তাদের যারাই অন্ধকারে নিক্ষেপ করার চেষ্টা করুন না কেন, কখনও সেই প্রয়াস সফল হবে না। বরং তারাই সেই অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবেন।
আমরা যারা রাজনীতি করি না, তবে রাজনীতির বাইরে নই। অন্তত কোনও মানুষই রাজনীতির বাইরের কেউ নন। তবে, অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক বিয়ষে চুপ থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করেন। বলা যায়, একটু সযত্নে এড়িয়ে চলাটাকে উত্তম মনে করে। কিন্তু আমাদের এর কঠিন যাঁতাকলে পড়তে হয়। তা হরহামেশা। এরপরও আমরা নীরবে সয়ে যাই। গণতন্ত্র মানে যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা তা কি সর্বত্র রয়েছে? সর্বত্র বললে ভুল হবে, এর ৫০শতাংশ জায়গায় কি এর চিহ্ণ আছে? কেউ বললে, তা হবে হাস্যকর। আমরা দেখেছি তত্ত্বাবধায়কের আমলে এক সেনাপ্রধান (অব.) উপদেষ্টা তার আয়-ব্যয়ের হিসাব দুদকে দাখিল করেন। কিন্তু এই একই জিনিস উপদেষ্টাদের একজন, আইনবিদ উপদেষ্টা প্রকাশ্যে তা দাখিল করবেন না ঘোষণা দেন। নিম্নপর্যায়ের কথা তো বাদ দিলাম। এই জবাবদিহিতা না-থাকার কারণে দেশ অতুলনীয় সম্ভাবনাময় থাকা সত্ত্বেও দিনে-দিনে পেছনের দিকে হাঁটছে, তা কম-বেশি সচেতন মানুষকে ব্যথিত করে, বিষণ্ন করে। এরশাদ নিয়ে কম রক্তপাত হলো না। তবু স্বৈরাচারী মানুষটি বাংলাদেশে রাজনীতি করেন, সেটাই কম বিস্ময়ের নয়! কাগজের পাতা উল্টালে তাকে নিয়ে কিংবা তার বিচিত্র প্রতিশ্রুতি আমাদের নজর কাড়ে। রাজনীতি কি তবে প্রতিশ্রুতির, দাবার চাল? জামায়াতকে বয়কটের পাশাপাশি এরশাদকে কেন করা হচ্ছে না—এ নিয়ে আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবীও প্রশ্ন তুলতে পারেন। বাসে, চায়ের স্টলে, পথে কিংবা ময়দানে কান পাতলে তাদের ভূমিকা নিয়ে নানা কথা ওঠে। বিভিন্ন জায়গায় অনেক বলতে শুনেছি, এরশাদকে রাজনীতির এন্টারটেইন্টমেন্ট হিসেব ধরা হয়। পরিস্থিতিকে অন্য দিকে যতই ঘোরানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, এটা প্রকৃতঅর্থে সত্য যে, এরশাদ একজন স্বৈরশাসক। আর সেই সময়ে যারা তার সঙ্গে ছিলেন তবে তারা কী? কিন্তু সেই মোসাহেবরাই দাপটের সঙ্গে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাই না? তবে নূর হোসেন কেন তার বুকের রক্ত রাজপথে ঢেলে দিলেন? তিনি সেই দিন এমন প্রতীকী ভূমিকায় নেমে জাতিকে কী বোঝাতে চেয়েছেন। যারা তাকে গুলিবিদ্ধ করল, যে জান্তা তাকে হত্যার নির্দেশ করল, তাদের তো কিছু হলো না। এ জন্য কোনও মিছিল মিটিং কিংবা অনশন হলো না।
আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগী মানুষের বলিদানকে স্মরণ করি ও অনুসরণ করি তাদের আদর্শকে ও বিশ্বাস করি সাম্যে ও গণতন্ত্রে; নূর হোসেন, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও, ক্ষমা করে দাও আমাদের বুদ্ধিজীবীদের। এখন আর অবাক হই না, এর কারণ, তোমার স্মরণ দিনে তোমার হন্তারকও তোমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা দেয়।
লেখক: কবি ও কথাশিল্পী
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।