X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আগুনে পোড়া শাহানা রক্ত বিক্রি করতেন!

জাকিয়া আহমেদ
২৬ জানুয়ারি ২০১৬, ০১:১৪আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০১৬, ০১:২১

বার্ন ইউনিটের বেডে শাহানা ‘অভাবের তাড়নায় আদ-দ্বীন হাসপাতাল আর ফরিদাবাদের বিভিন্ন ক্লিনিকে রক্ত বিক্রি করেছেন আমার বোন। আমাকে বলেননি, পরে শুনেছি। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। যৌতুকের কারণে বোনটাকে মেরে  ফেলার জন্য গায়ে আগুন দিয়েছেন বোনজামাই।’ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পেছনে বসে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কথাগুলো বলছিলেন অগ্নিদগ্ধ শাহানার ভাই শাহিন।
শাহানা তখন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চারতলায়  ব্লু ইউনিটের ফিমেল ওয়ার্ডের মেঝেতে শুয়ে রয়েছেন। চিকিৎসকের ভাষায় শাহানার শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। শাহিন বলে চলেন, ‘উনি  (শাহানার স্বামী) জানেন, আমরা গরিব।  কিছুই করতে পারব না। এ জন্য হুমকি দিতেন। উনি সরকারি অফিসে ফটোকপি সাপ্লাই দেন। সরকারি অনেক লোক তার পরিচিত। এজন্য তার অনেক দাপট। কিন্তু আমাদের তো কেউ নেই।’
বার্ন ইউনিটের ব্লু ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, মেঝেতে মাদুরের ওপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে রয়েছেন শাহানা। বাম হাতসহ বুক পুড়ে গেছে। দুই মেয়ে, এক ছেলেটা পাশে বসে রয়েছে। বড় মেয়েটির বয়স ১০ বছর, ছোট মেয়ের বয়স ৬ আর ছেলের বয়স সাড়ে তিন বছর।
কাছে যেতেই বলেন, ‘নাকের নলের কারণে কিচ্ছু খাইতে পারতাছি না, নলটা খুইলা দেন। একটু ভাত খাই।’ পাশে দাঁড়ানো শাহিন বলেন, ‘আপনাকে ডাক্তার মনে করে এসব কথা বলছেন।’
এই প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে কষ্টের ঝাঁপি মেলে ধরেন শাহানা। বলেন, ‘সারাজীবন কষ্ট করেছি। একটু সুখের জন্য ঘর বাঁধলাম আবার। কিন্তু  যন্ত্রণার শেষ বোধ হয় আমার কপালে নেই। তাই আমার আজ এ অবস্থা। মা নেই, বাপ নেই, তিনটা সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরের মাঝে পড়েছি। স্বামী দিনের পর দিন নির্যাতন করেন। তার লাগানো আগুনে শুধু আমি নই, আমার সঙ্গে তিন সন্তান আর আমার ভাইও পুড়ছে। এর কি কোনও বিচার নেই? আমি কি এর বিচার পাবে না আপা? আমার স্বামী আমাকে হুমকি দেন, ‘‘তুই বিচার চাইবি, আদালত যাইবি, মামলা করবি? কিছুই করতে পারবি না আমার।’’ আমি তো অসহায়, টাকা পয়সা নেই আমার। আত্মীয় স্বজন নেই, কে আমাকে সাহায্য করবে।’

শাহানার পাশে সন্তানরা  

শাহানা বলেন, গত বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারি দুপুর ২ টা। বাসায় এসে বকাবকি করেন, মাইরধর করেন। গত তিনমাস ধরে বাসাভাড়া দেন না। সেদিন এসে চুলা জ্বালিয়ে চুলায় ধাক্কা দিয়েছেন।  ওড়না পুড়ে গেলে আমি আর ছাড়াইতে পারিনি। ইনকাম করেন ভালো। কিন্তু আমারে দেন না। আমার মাথায় তেল নেই, পেটে ভাত নেই। পরনে কাপড় নেই। সব এই ভাই দেয়। সবাই বলে, ভাইটার কারণেই বোনটা বেঁচে আছেন। এই বাচ্চাগুলাকে আমার ভাই যতটুকু পারে, ততটুকুই খাওয়ায়।’

শাহানা বলেন, ‘সেদিন আগুন দিয়ে পালিয়ে গেছেন। মুখোশের আড়ালে ভদ্রলোক। ভাইরে বলি, আমি তো মরে যামু। তুই আদালতে বিচার দে। ওর বিচার হওয়া দরকার, জনগণ দেখুক।’

শাহানার ভাই শাহীন বলেন, ‘আমরা অল্প আয়ের মানুষ। পোস্তগোলার হাসনাবাদে থাকে বোন। সেখান থেকে ফোন দেন, তাড়াতাড়ি আসেন, আপনার বোনের সমস্যা হইছে। আমি গিয়ে দেখি বোনটা পুড়ে গেছে।বোনের সঙ্গে একটু রাগও করলাম।  কাজটা কেমনে হইলো। কিন্তু সেই সময়ে তো আর বোন কথা কইতে পারতেছিলেন না। বাড়িতে কেউ না থাকায় আগুন দিয়ে দিয়ে পালিয়েছেন বোনজামাই। তখন আমি বোনকে হাসপাতালে নিয়ে আসি।’ 

শাহিন জানান, ‘বোনজামাইকে ফোন দিলেই গালিগালাজ করতেন। বোনকে দিনের পর দিন নির্যাতন করে আসছেন। কিন্তু আমি আমার বোনকে সান্ত্বনা দিতাম—আমি তো আছি, যতটুকু পারি আমি দেখব। আমি ভাবতাম, বোনটার দ্বিতীয় বিয়ে, তিনটা সন্তান। আমি যদি কোনও মামলা করি, তাহলে বোনটা আলাদা হয়ে যাবেন।  তিন সন্তান নিয়া তিনি আরও দুঃখের ভেতরে পড়বেন।  আরও কষ্ট বেড়ে যাবে।  এসব কিছু চিন্তা করেই বোনকে বুঝাইতাম। আমার একার পক্ষে তো এতকিছু করা সম্ভব না, যেটুকু পারি আমি দেখি।’

শাহানার তিন সন্তান

কান্নাভেজা কণ্ঠে শাহীন আরও বলেন, ‘আমারও তো সংসার আছে। আমি আমার সংসারে না দিয়ে বোনরে দেই। আমার দুটা ভাগ্নি একটা ভাইগ্না না খেয়ে থাকবে। ওদের কষ্ট সইতে পারি না। আমি ছোট একটা দোকান চালাই। আমার তো বেশি সামর্থ্য নেই। চুপচাপ থাকি এ জন্য। সবার সঙ্গে ভদ্র কথা বলে আর বোনটাকে যে কী পরিমান অত্যাচার করে এটার সাক্ষী অনেক লোক।’

তবে,  দুই মাস আগে যাত্রাবাড়ী থানায় নিজে বাদি হয়ে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করেন শাহানা।

সোমবার মোবাইল ফোনে শাহিন জানান, ‘সেই বৃহস্পতিবার থেকে আজ পর্যন্ত কোনও খোঁজ নেননি বোনজামাই। এমনকি কোনও ফোন কলও ধরছেন না।’ শাহিন জানান, ‘হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকের পরামর্শপত্র নিয়েই তিনি আরেকটি মামলা করবেন। শাহিন বলেন, শেরপুরে থাকার সময় ছোট মেয়েকে পানিতে ফেলে মারতে চেয়েছেন।  কারণ মেয়েটা ওনার না। মেয়ে দুটোকে অনেক মারধর করেন। কারণ, আপার প্রথম সংসারের সন্তান মেয়ে দুটো। ছোট মেয়েটাকে মেরে  ফেলার হুমকি দিতেন।  আমাকে বলতেন, আপনার ভাগ্নিরে যা ইচ্ছা করেন। আমি তার ভয়ে মেয়েটাকে এখানে-ওখানে রাখতাম। ভাগ্নিতো ফেলতে পারিনি।’

শাহিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বোনটা যখন কাঁদতেন, তখন শুধু বলতাম, আমি আছি, আমি তো মরি নাই।আমাদের বাপ-মা নেই। ভাই-বোন দুজন।  বোনটাকেও যদি এভাবে হারাই, তাইলে আর থাকল কী?’

/এমএনএইচ/  

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি