X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১
শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর গৌরব ও আক্ষেপ

‘জগন্নাথ হলের ঘাসে আমাদের রক্তমাখা’

আমানুর রহমান রনি
১৭ এপ্রিল ২০১৬, ০৭:০২আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০১৬, ০৭:০৯

স্বামীর ছবি হাতে রাজকুমারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলের মাঠের ঘাস আমাদের রক্তেভেজা অথচ এখন ফল ভোগ করে অন্যরা।আমরা প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাচ্ছি না। স্বাধীনতার পর অর্ধাহারে অনাহারের কাটিয়েছি। সন্তানদের মানুষ করেছি, কিন্তু কেউ আমাদের সহায়তা করেনি। এমন আক্ষেপ জগন্নাথ হলের অফিস সহকারী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মনভরণ রায়ের স্ত্রী রাজকুমারী রায়ের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো।হানাদাররা টার্গেট করেছিল দেশের মেধাবী সন্তানদের।ওই রাতে জগন্নাথ হলে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাক বাহিনী।শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীসহ হত্যা করা হয়েছিল কয়েকশ’ মানুষকে। জগন্নাথ হলের তৎকালীন অফিস সহকারী মনভরণ রায়ও শহীদ হয়েছিলেন সেই রাতে। পাক সেনাদের ব্রাশ ফায়ারে ক্ষতবিক্ষত স্বামীর বুক থেকে বের হওয়া রক্তের স্রোতে সেদিন জগন্নাথ হলের মাঠের ঘাস চুইয়ে পড়তে দেখেছিলেন রাজকুমারী। ছোটছোট তিনসন্তান নিয়ে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়েছেন এই নারী। জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময় প্রাপ্যসম্মানটুকু না পাওয়ার আক্ষেপ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মনভরণের স্ত্রীর মুখে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সেদিনের সেই রক্তেমাখা ঘাসের কথা আজও ভুলেনি। অথচ তাদের সেই ত্যাগের কথা আমরা কি ঠিকভাবে মনে রেখেছি? বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই প্রশ্ন তিনি করেছেন। উত্তরও দিয়েছেন অনেক প্রশ্নের। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

বাংলা ট্রিবিউন : ২৫ মার্চ রাতে কি ঘটেছিল জগন্নাথ হলে?

রাজকুমারী : ওই দিন সারাদিন ডিউটিতে ছিলেন। দেশে গন্ডগলের কারণে অফিসে ওইদিন কাজ কমছিল। তাই একটু আগেই তিনি বাসায় চলে আসেন। বাসার সামনে বসে রামায়ন শুনতেছিলেন। আমি তাকে বাজারে যেতে বলি। কিন্তু বাজারে যাওয়ার আর সময় হলো না। রাত সাড়ে ৯ টার দিকে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। এরপর রাত ১২ টার দিকে হঠাৎ একটানা গুলি। ‍গুলির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। হলের চারদিকে আগুন দিয়ে দেয় পাকসেনারা। এরপর প্রাণের ভয়ে সবাই বাসা থেকে বের হই।

 বাংলা ট্রিবিউন : গুলির শব্দের পর ঘুম থেকে উঠে আপনি কি দেখলেন?

রাজকুমারী : সারা রাত হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় কলোনিতে। বেঁচে থাকা পুরুষদের ধরে ওরা। সব জায়গা থেকে লাশ বহন করে মাঠের মাঝখানে স্তূপ করতে বাধ্য করে তাকে দিয়ে। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। এরপর তাদেরও ভোরে লাইনে দাঁড় করানো হয়। তারপর ব্রাশফায়ার করে। এরপর পাকসেনারা চলে যায়। তখন লাশগুলোর মধ্য থেকে ‘জল জল’ বলে গোঙানির শব্দ কানে আসে। সামনে গিয়ে দেখি, ওদের বাবা তখনো বেঁচে আছেন। অনেক কষ্ট করে কলোনির দিকে মানুষটাকে নিয়ে এলাম। পানি খাওয়ালাম। এর একটু পর তিনি মারা যান। কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলো ভয় পাচ্ছিল। তাকে সেখানে রেখে আসার জন্য তারা আমাকে চাপ দিচ্ছিল। কারণ লাশ বাসায় নিয়ে এসেছি এই কথা পাকসেনারা জানলে জীবীতদেরও মেরে ফেলতে পারে বলে একটা ধারণা ছিল। তাই তার লাশ আবার মাঠে রেখে আসি। তিনি ২০ মিনিট বেঁচেছিলেন তিনি। ছোট মেয়েটা তখন কাঁদছিল। ভয়, কখন মিলিটারিরা আসে। ওকে দূরে রেখে এসে দেখি সব শেষ। 

 

রাজকুমারী ও তার ছেলে বাংলা ট্রিবিউন: এরপর কি করলেন?

রাজকুমারী: সবার সঙ্গে সকালে আমার ছোটছোট দুইছেলে ও একমেয়ে নিয়ে জগন্নাথ হল ছেড়ে হোসনী দালানে আশ্রয় নেই। সেখান থেকে গিয়ে কিছুদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশঘরে থাকি। এরপর মুন্সীগঞ্জ চলে যাই। কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা না থাকায় স্বাধীনতার পর আবার এখানে ফিরে আসি। কিন্তু কি খাব? কি করব? কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

 

বাংলা ট্রিবিউন : স্বাধীন বাংলাদেশে আপনার যুদ্ধ শুরু হলো। ছোটছোট সন্তান নিয়ে কিভাবে তখন সংসার চালিয়েছেন?

রাজকুমারী : জীবনে যে কষ্ট করেছি তা বলে বুঝাতে পারবো না। এসব বলতেও আর ভালো লাগে না। এক মূহুর্তের জন্যেও কোনও শান্তি পেলাম না। 

বাংলা ট্রিবিউন : স্বাধীনতার পর সরকার কি ধরনের সহযোগিতা করেছে?

রজাকুমারী : আমরা কিছুই পাইনি। জগন্নাথ হলের এই জায়গাটুকু না পেলে আমাদের থাকারও জায়গা থাকত না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুই হাজার টাকা দিয়েছিল। আর কিছুই পাইনি। আমাদের রক্তেমাখা এই জগন্নাথ হলের ঘাস, অথচ আমাদের কেউ জিজ্ঞাস করেনি। কেউ বলতে পারবে না কেউ চারআনা পয়সা দিয়েছে। যে ক্ষমতায় আসে সে নিজেই ঘাট্টিবেধে দৌড়ায়। 

বাংলা ট্রিবিউন : স্বাধীনতার এতো বছর পর আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশ ঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে?

রাজকুমারী : বাংলাদেশ চলছে। আরও চলবে। এসব কথা আমাদের বলে কোনও লাভ নেই। কেউ কারো জন্য কিছু করবে না। নিজের বলই বড় বল।

 

বাংলা ট্রিবিউন : আপনাকে ধন্যবাদ।

রাজকুমারী : আচ্ছা, আপনাদেরও ধন্যবাদ।

 

ছবি তুলেছেন: সাজ্জাদ হোসেন।

 

/এআরআর/ এমএসএম /

সম্পর্কিত
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও মানস ঘোষমুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবাদ সংগ্রহ
করারোপ নীতি শিক্ষা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে: সলিমুল্লাহ খান
বাংলা ট্রিবিউনকে ওয়াসিকা আয়শা খান‘নারীরা যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন, এর নেপথ্যে শেখ হাসিনা’
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
‘মুম্বাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেললে ব্রেইন ফেটে যাবে’
‘মুম্বাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেললে ব্রেইন ফেটে যাবে’
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার: যেসব নির্দেশনা দিলো পিএসসি
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার: যেসব নির্দেশনা দিলো পিএসসি
দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে লড়ছে ভাই-ছেলে, শাজাহান খান বললেন, ‘পরিবারের ঐতিহ্য’
উপজেলা নির্বাচনদলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে লড়ছে ভাই-ছেলে, শাজাহান খান বললেন, ‘পরিবারের ঐতিহ্য’
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান