X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুই নেতার ফোন: ঘরে ফিরছেন বিএনপির সংস্কারপন্থীরা

বিশেষ প্রতিনিধি
০৮ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:০৩আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০১৬, ১২:২২

 

বিএনপি সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত দলীয় নেতাদের এবার দলের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। বললেন, তারা যদি বিএনপির বিরুদ্ধে কথা না বলেন, তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্ব-স্ব আসনে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে সংস্কারপন্থী নেতাদের এই আশ্বাস দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মোহম্মদ শাহজাহান।  এই দুই নেতা বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করতে চাননি। জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘সংস্কারপন্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথাবার্তা অনেকদিন ধরেই চলছে। তারা দলে ফিরবেন এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কবে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল।’

তবে  সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত অন্তত সাতজন সংসদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানিয়েছেন, মির্জা ফখরুল ও মোহম্মদ শাহজাহান তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আশ্বাসও দিয়েছেন।

জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সংস্কারপন্থীদের অনেক প্রলোভন দিয়েও গত নির্বাচনে সরকার নিতে পারেনি। এছাড়া তারা বিএনপিরই প্রডাক্ট। ফলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবেন, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কবে হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’ 

মোহম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘‘বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অ্যাকোমোডেটিভ’ মানসিকতার নেতা। তিনি সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চান। ফলে সংস্কারপন্থী কিংবা জাতীয়তাবাদী শক্তির সবাই বিএনপির সঙ্গে থাকবেন।’’ তিনি জানান, ‘আলাপ-আলোচনা অব্যাহত আছে। দেখা যাক কী হয়!’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাবেক সংসদ সদস্য নজির হোসেন, জহিরউদ্দিন স্বপন, সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, মফিকুল হাসান তৃপ্তি ও ডা. জিয়াউল হক মোল্লাসহ সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় বিএনপি নেতাদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নেতাদের অন্তত তিনজন স্বীকার করেন, বিএনপির দুই নেতা তাদের ফোন করেছিলেন।

জানতে চাইলে জহিরউদ্দিন স্বপন বলেন, ‘সংস্কারপন্থীদের বিএনপিতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। এ ধরনের যোগাযোগ আগে হয়েছে, সম্প্রতিও হয়েছে।’   তিনি বলেন, ‘আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলছে;  আমরা আশাবাদী, যথাযথভাইে এটি সম্পন্ন হবে। কেননা, অতীতের ভুল সংশোধন করে জাতীয়তাবাদী শক্তির বৃহত্তর পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া বিএনপির সামনে কোনও বিকল্প পথ নেই।’ তিনি জানান, ‘সংস্কারপন্থীরা অপেক্ষায় আছেন, এটি যেমন ঠিক; তেমনি তারা ব্যক্তিস্বার্থে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতেও রাজি নন এটাও ঠিক।’

সাবেক সংসদ সদস্য নজির হোসেন বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়। শুনি আমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু কবে তা জানি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কারপন্থীদের মধ্যে যোগাযোগ ও ঐক্য আছে। ফিরে গেলে সবার একসঙ্গে যাওয়াই ভালো।’ তার মতে, ‘বিচ্ছিন্নভাবে ফিরে গেলে রাজনৈতিকভাবে সংস্কারপন্থীদের কোনও লাভ হবে না। বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একজনের লাভ হতে পারে। তবে আমরা অপেক্ষায় আছি, বিএনপিতে ফিরতে চাই।’  

ডা. জিয়াউল হক মোল্লার মতে, ‘একজন-দু’জন বিচ্ছিন্নভাবে ফিরে লাভ নেই। সবাই সম্মিলিতভাবে ফিরলে বরং বিষয়টির রাজনৈতিকভাবে সমাধান হয়।’  তিনি বলেন, ‘সংস্কারপন্থী একটি বিশেষ রাজনৈতিক ধারা বা ট্রেন্ড।  আমরা চাই সবাই একযোগে ফিরে এ বিশেষ ধারা বা ট্রেন্ডের সমাপ্তি হোক।’ 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি নেতাদের আশ্বাসের পর সংস্কারপন্থী নেতারা নিজেদের মধ্যে দফায়-দফায বৈঠক করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, বিএনপিতে ফিরলে সবাই একসঙ্গে ফিরবেন। তাদের মধ্যে এ আলোচনাও হয় যে, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও খালেদা জিয়া নির্বাচনে না যাওয়ার শর্তে তাদের বিএনপিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু কথা রাখেননি। ফলে এবারের আশ্বাসের ওপরও পুরোপুরি নির্ভর করা ঠিক হবে না। বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ঐক্য ধরে রাখার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন তারা।

২০০৭ সালের ২৬ জুন ১৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং তাকে সমর্থনকারী নেতারা সংস্কারপন্থী বলে বিএনপিতে পরিচিতি লাভ করেন। ওই বছরেরই ৩ সেপ্টেম্বর মান্নান ভূঁইয়াকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হলে সংস্কারপন্থীরা তার নেতৃত্বে তৎপরতা চালাতে থাকেন। কার্যত তখন থেকেই বিএনপিতে সংস্কার ও অসংস্কারপন্থী দুটি ধারা তৈরি হয়। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব হওয়ার পর বিভেদ আরও বাড়ে। কারণ তিনি ঢাকা মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কমিটি গঠনের নামে সংস্কারপন্থীদের বিতাড়িত করেন। বিশেষ করে মান্নান ভূঁইয়ার সমর্থকদের দলে তিনি কোণঠাসা করেন।  এদিকে মান্নান ভূঁইয়ার মৃত্যুর পর সংস্কারপন্থীরা কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েন। যদিও তার সমর্থক অর্ধ শতাধিক সাবেক সংসদ সদস্য ও নেতা এখনও বিএনপির বাইরে রয়ে গেছেন। গত দুটি নির্বাচনে তারা মনোনয়ন পাননি। পাশাপাশি বিএনপির কোনও কর্মকাণ্ড এবং কমিটিতেও তাদের নাম নেই।

এ তালিকায় উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে মেজর জে. (অব.) জেডএ খান, মোফাজ্জল করিম, আশরাফ হোসেন, শাহ মো. আবুল হোসাইন, শহিদুল হক জামাল, জহিরউদ্দিন স্বপন, মফিকুল হাসান তৃপ্তি, নজির  হোসেন, সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, জিএম সিরাজ, ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, এসএ সুলতান টিটু, ইঞ্জিনিয়ার শহিদুজ্জামান, নুরুল ইসলাম মনি, শামীম কায়সার লিঙ্কন, ইলেন ভুট্টো, আলমগীর কবীর, আবু হেনা, আবদুল গণি (মেহেরপুর), দেলোয়ার হোসেন খান দুলু (ময়মনসিংহ), আতাউর রহমান আঙ্গুর (নারায়ণগঞ্জ), আবদুল করিম আব্বাসী (নেত্রকোনা), আবু ইউসুফ খলিলুর রহমান (জয়পুরহাট), মেজর জে. (অব.) আনোয়ারুল কবীর তালুকদার (জামালপুর), এমএম শাহীন (মৌলভীবাজার), ফজলে আজিম (নোয়াখালী). শাম্মী শের (মুন্সীগঞ্জ), একেএম আনোয়ারুল হক, (ময়মনসিংহ) শাহরিয়ার আক্তার বুলুসহ অনেকের নাম রয়েছে। 

সূত্র জানায়, এই নেতাদের মধ্যেই ১৮ জন বিএনপির কাছে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেন যে, তারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সঙ্গেই থাকতে চান। ৫ জানুয়ারির আগে সাদেক হোসেন খোকার বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তারা ওই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন। যা পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার কাছে দেওয়া হয়। সংস্কারপন্থী ওই নেতাদের পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত উপজেলা  ও পৌরসভা নির্বাচনে স্ব-স্ব এলাকায় গিয়ে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। শুধু তাই নয়, অনেক পৌরসভায় প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে সংস্কারপন্থীদের পরামর্শও নেওয়া হয়। এরপর খালেদা জিয়ার নির্দেশে তারা বিএনপি-প্রার্থীর পক্ষে কাজও করেন বলে জানা যায়। কিন্তু সর্বশেষ অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পরে গত ৩ আগস্ট ঘোষিত কমিটিতে নাম না থাকায় সংস্কারপন্থীরা হতাশ হয়ে পড়েন।

সংস্কারপন্থীদের আশা ছিল,  ওই কমিটিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কিন্তু ঘোষিত ৫০২ সদস্যের কমিটিতে  কারও নাম থাকায় প্রচণ্ড হতাশ হয়ে ওই নেতাদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ওই সময় বেশকিছু গণমাধ্যমে সংস্কারপন্থীদের তৎপরতা নিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, পদবঞ্চিত নেতাদের পাশাপাশি দলের বাইরে থাকা সংস্কারপন্থীরা সময় হলে একজোট হয়ে পৃথক রাজনৈতিক অবস্থান নিতে পারেন।

সূত্রমতে, তাদের এই তৎপরতার কথা খালেদা জিয়াকে অবহিত করেন বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। তারা বলেন,  ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের সময় বিএনপির অনুরোধেই সংস্কারপন্থী সাবেক অন্তত অর্ধ শতাধিক সংসদ সদস্য নির্বাচনের বাইরে ছিল। পাশাপাশি ওই সময় তারই নির্দেশে সাদেক হোসেন খোকার বাসায় বৈঠকসহ সার্বিক বিষয়ে খালেদা জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সিনিয়র নেতারা। খালেদা জিয়াকে তারা আরও বলেন যে, বিএনপিতে ফিরিয়ে নেওয়া না হলে সরকার আগামী নির্বাচনে সংস্কারপন্থীদের কাজে লাগাতে পারে। সিনিয়র নেতাদের ওই মতামতের কারণেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মোহম্মদ শাহজাহানকে সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেন খালেদা জিয়া।

উল্লেখ্য, বিএনপির প্রয়োজন এবং দুই-একটি ক্ষেত্রে লবিং ছাড়াও বিভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে সংস্কারপন্থীদের বড় একটি অংশ বিএনপিতে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, সাদেক হোসেন খোকা, ড, ওসমান ফারুক, আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়াম, শাহ মোহম্মদ আবু জাফর, আসাদুল হাবিব দুলু, মাসুদ অরুণ, মোশাররফ হোসেন মঙ্গু, শামসুল আলম প্রমানিক, রেজা আহমেদ বাচ্চু, শহিদুজ্জামান বেল্টু, মোজাহের হোসেন, নাসিরুল হক সাবু, ড. সালেক চৌধুরী ও কাজী রফিকসহ অনেকেরই নাম রয়েছে। তবে সংস্কারপন্থী বলে পরিচিতি লাভ  করায় দলে তারা কাঙ্ক্ষিত পদ পাননি।

/এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!