X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অভিমান!

সালমান তারেক শাকিল
১০ মার্চ ২০১৭, ১৯:২৯আপডেট : ১০ মার্চ ২০১৭, ১৯:৩৭

বিএনপি সমর্থিত চার বুদ্ধিজীবী এমাজউদ্দীন আহমদ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ফরহাদ মজহার ও মাহমুদুর রহমান

বিএনপির অবহেলা-অবমূল্যায়ন এবং পরামর্শ-মতামত গ্রহণে অনীহাসহ নানা কারণে দিন দিন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন দলটির সমর্থক জ্যেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক ও পেশাজীবীরা। খালেদা জিয়ার কাছ থেকে উৎসাহ না পাওয়ায় দলীয় কর্মসূচি থেকেও বিরত থাকছেন তারা। গুটিয়ে রেখেছেন দলীয় প্রধানের ডাকা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠনের তৎপরতা থেকে। পাশাপাশি থিংক ট্যাংক হিসেবে বিভিন্ন পেশাজীবী বিশিষ্টজন কাজ করলেও বর্তমানে তারা দূরে রয়েছেন। বিএনপিপন্থী অন্তত পাঁচ জন বুদ্ধিজীবী ও কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘এটা বুদ্ধিজীবীদের অভিমানজনিত প্রতিক্রিয়া। ক্ষুব্ধ হয়ে দল থেকে দূরে সরবেন না।’

জানা গেছে, বুদ্ধিজীবীদের দেওয়া পরামর্শ ও মতামত গ্রহণে বিএনপির ধারাবাহিক নেতিবাচক আচরণ ও উপেক্ষার কারণে দলটির সিনিয়র বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শফিক রেহমান, ফরহাদ মজহারসহ কয়েকজন নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মুক্তি পেলেও রাজনৈতিক কোনও কর্মকাণ্ডে নেই। এরই মধ্যে সম্প্রতি সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি সেমিনারে অংশ নিলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই সেমিনার করতে দেয়নি। সেখানে ফরহাদ মজহারও ছিলেন।

বিএনপির কর্মকাণ্ডে  মূলত বুদ্ধিজীবীদের নিষ্ক্রিয়তা শুরু হয় গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে। ওই সভায় দেখা যায়নি বিএনপিপন্থী কোনও বুদ্ধিজীবীকে ।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, দলটিকে নানা সময় পরামর্শ দিতেন কয়েকজন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদী, আইনজীবী, অধ্যাপক, ও আইনবিদ। নানা সময়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বা ভিন্ন কোনও উপায়ে দলের বিষয়ে পরামর্শ ও সুপারিশ তার হাতে তুলে দিতেন লিখিতভাবে। এই প্রক্রিয়াটিও বিএনপি প্রধানের পরামর্শেই তারা শুরু করেছিলেন। যদিও একটি অদৃশ্য শক্তির হস্তক্ষেপে তাদের প্রস্তাবগুলো হয় হারিয়ে গেছে, নয়তো স্থগিত করা হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে প্রস্তাবগুলোকে সুকৌশলে দলীয় প্রধানের কার্যালয় থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

খালেদা জিয়া গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর সৌদি বাদশাহ’র আমন্ত্রণে হজে গেলেও কোনও বুদ্ধিজীবীই বিমানবন্দরে বিদায় জানাননি। একইভাবে তিনি ২২ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরলেও দলীয় নেতাকর্মীদের বাইরে শুভেচ্ছা জানাতে বিমানবন্দরমুখী হননি কেউ।

জানতে চাইলে এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বয়স হয়েছে। এখন বিতর্কিত হতে চাই না। আদর্শের জায়গা থেকে বিএনপির জন্য কাজ করেছি। এখনতো শরীরে কুলোয় না। তাই নিয়মিত যাওয়া হয় না।’

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে দূরে কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিব্রত করো না’ বলে প্রতিবেদককে উত্তর দিতে অনীহা জানান।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এতে স্পেশালিটি কিছু নেই। তারা যখন মনে করেন বিএনপির পরামর্শ দরকার, তখন দেন। যখন ম্যাডামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান, করেন।’

বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়াকে পরামর্শমূলক খোলাচিঠি দেন। সাড়ে তিন হাজার শব্দের ওই চিঠিতে দলে গণতন্ত্রচর্চা, জামায়াত বিষয়ে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ওই চিঠির পর বিএনপি থেকে কোনও সাড়া পাননি তিনি। এমনকি দলের অভ্যন্তরে মূল্যায়নধর্মী কোনও আলোচনাও হয়নি।

এ ব্যাপারে জাফরুল্লাহ চৌধুরী কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন,‘এসব নিয়ে বলতে চাই না। অনেক হয়েছে।’

প্রয়াত পিয়াস করিম খালেদা জিয়াকে দুটো লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওই দুটো প্রস্তাব সম্পর্কে খালেদা জিয়াকে বিশদ জানানো হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়,বিএনপি  ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, জিডিপি’র গ্রোথ ও রামপাল নিয়ে যে প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছে, সেগুলো থিংক ট্যাংকের কাজ। এই থিংক ট্যাংকের কাজ সমন্বয় করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদসহ কয়েকজন। আগামী দিনে সহায়ক সরকার ও  বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির ওপর ফলোআপ নিয়েও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বিএনপি।

গত বছরের আগস্ট মাসের প্রথম মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জামায়াতের বিষয়ে কথা বলেছিলেন বিএনপিপন্থী শীর্ষ বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেই সক্রিয় হবেন হতাশ এমাজউদ্দীন! এরপর জামায়াত নেতা ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, এমাজউদ্দীন সাহেবরা কোন উদ্দেশ্যে কার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এ ধরনের আপত্তিকর ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, তা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ঘটনার রেশ নতুন মাত্রা লাভ করে একদিন পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যের পর। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এমাজউদ্দীন সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা কোনও দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’’

মির্জা ফখরুলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার  পর বিএনপির যাবতীয় অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন এমাজউদ্দীন। অদ্যাবধি তিনি বিএনপির কোনও অনুষ্ঠানে বা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেননি।

এমাজউদ্দীনের পরিবারের এক সদস্যের ভাষ্য, ‘মতামত গ্রহণ না করা হলে কেন যাবেন তিনি। ৮৩ বছর বয়সে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে রাত সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়।এরপর ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফিরতে রাত ১১টা বেজে যায়। এভাবে কতদিন। বিএনপির পক্ষে কথা বলতে গিয়ে তো উনাকেও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।’

তার ঘনিষ্ট এক কবি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দলের কোনও স্তরে গণতন্ত্র চর্চা নেই। তৃণমূলে কমিটি হচ্ছে, কিন্তু নির্বাচন হচ্ছে না। নির্বাহী কমিটি গঠনে মানা হয়নি জ্যেষ্ঠতা। দলে কোনও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নেই।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা যখন যেটা ভালো মনে করেন, তারা পরামর্শ দেন। এখানে তাদের যখন সময়-সুযোগ হয় তখন তারা কথা বলেন।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এটা আপনাদের ধারণা। আপনার কথার সঙ্গে আমি একমত নই। আমাদের নিয়মিত কথা ও আলোচনা হয়।’

জানা গেছে, সম্প্রতি ভারতের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ, আগামী নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে চুপ থাকা এবং সরকারের বিরুদ্ধে যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরতে ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপি। এ নিয়ে একাধিকবার দলীয় নীতি ঠিক করতে এমাজউদ্দীনসহ বিশিষ্টজনেরা পরামর্শ দিলেও কোনও আমলে নেয়নি বিএনপির হাইকমাণ্ড।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন বলেন, ‘পৃথিবীতে কিভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, এ বিষয়গুলো জানতে হবে।’ তার ধারণা থেকে আশঙ্কা, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে এলে টাকা পয়সা খরচ করে হলেও সরকার বিএনপির একটি অংশকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করবে। ফলে, এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’

বিএনপিপন্থী সাংবাদিক শফিক রেহমানও জামিনে মুক্তি পেয়ে দলীয় কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বা কর্মকাণ্ডে যোগ দেননি। সম্প্রতি তিনি লন্ডনে চলে গেছেন। কারাগারে যাওয়ার আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে শফিক রেহমানের নিয়মিত যোগাযোগ ও পররাষ্ট্র বিষয়ে শলা-পরামর্শ হলেও গত ছয় মাসে দূরত্ব ছিল উভয়ের মধ্যে।

বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বুদ্ধিজীবীদের যেকেউ গেলেই দলীয় প্রধান তাদের ডেকে কথা বলেন ও পরামর্শ শোনেন। তাদেরকে লিখিতভাবে দলের জন্য প্রস্তাব দেওয়ার অনুরোধ করেন। যদিও চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের ও দলের একটি গোষ্ঠী বুদ্ধিজীবীদের দেওয়া প্রস্তাব খালেদা জিয়ার মনোযোগ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

/এসটিএস/ এপিএইচ/

আরও পড়ুন: 
এক ছাতার নিচ থেকেই হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার হামলা!

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক