পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশে ইফতারকেন্দ্রিক সৌজন্যমূলক রাজনীতির চর্চা অনেকদিন ধরেই চলছে। এই ইফতার রাজনীতিতে বিগত বছরগুলোতে বিএনপি তেমন আলোচনা সৃষ্টি করতে না পারলেও এ বছর তাদের তৎপরতা ভিন্ন। এ রমজানে দুটি ইফতার মাহফিল আয়োজন করতে পারাটা সাফল্যের মনোভাব হিসেবে কাজ করছে দলটিতে। ২৯ মে কূটনীতিকদের সঙ্গে এবং ৫ জুন রাজনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত দুটো ইফতার পার্টিতে অতিথিদের সমাগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কৌশলে নতুন দিক যুক্ত করেছে বলে মনে করছেন দলটির পর্যবেক্ষকরা।
গত ২৯ মে রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে কূটনীতিদের সম্মানে ইফতার আয়োজন করেন খালেদা জিয়া। ওই ইফতার অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে একই টেবিলে বসে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও ভারতের হাইকমিশনার ছাড়াও ইফতার করেন যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক, ভ্যাটিকেনের রাষ্ট্রদূত আর্চ বিশপ জর্জ কোচেরি, চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিং কিয়াং, কুয়েতের রাষ্ট্রদূত আবদেল মোহাম্মদ এ এইচ হায়াত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু, পাকিস্তানের হাইকমিশনার রফিউজ্জামান সিদ্দিকী, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওসতুর্ক, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিডসেল ব্লেকেন ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এটাই প্রথম এবং একইসঙ্গে এতজন কূটনীতিক খালেদা জিয়ার সঙ্গে ইফতারে অংশ নিয়েছেন।বিশেষ করে ইফতার আয়োজনের আগে-পরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে দেশ দুটির আগ্রহ ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ।
গত ৫ জুন রাজধানীর বড় একটি হলে রাজনৈতিক নেতাদের সম্মানে ইফতার আয়োজন করেন খালেদা জিয়া। ওই ইফতারে বিকল্প ধারার সভাপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জেএসডি সভাপতি আসম রব; তার স্ত্রী তানিয়া রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদারসহ (বীর প্রতীক) কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতি নতুন মাত্রা এনে দেয়। এক পাশে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের রেখে ইফতার শুরুর আগে খালেদা জিয়ার দশ মিনিট সৌজন্যমূলক আলোচনা রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রথমবারের মতো রাজনীতিকদের সম্মানে আলাদা ইফতার আয়োজন করে আমন্ত্রিতদের জন্য বিএনপি নেতাদের বাড়তি খাতির ওইদিন ছিল সবদলের জন্য।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, আগের বছরগুলোয় রাজনীতিকদের ইফতারে ২০ দলীয় জোটের বাইরের অন্য দলগুলোর অংশগ্রহণ ছিল কম। এছাড়া খালেদা জিয়াও আমন্ত্রিত নেতাদের সঙ্গে তেমন একটা সময় ব্যয় করেননি। এবার ঘটেছে ভিন্ন। ইফতারের আধাঘণ্টা আগে হলরুমে প্রবেশ করার পর তার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছোট রাজনৈতিক দলের বড় নেতাদের টেবিলে নিয়ে আসেন খালেদা জিয়াকে। এরপর সেখানেই বসে তিনি পারিবারিক আলোচনা, স্বাস্থ্যবিষয়ক কুশলাদির মাঝে-মাঝে আকারে-ইঙ্গিতে, চোখের ইশারায় রাজনৈতিক ভাবের আদান-প্রদান সেরে ফেলেছেন আমন্ত্রিতদের সঙ্গে।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলছেন, ‘তারা বিএনপি জোটে না থাকলেও বা জামায়াতের কারণে না আসলেও ইফতারে আসাটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তারাও এই সরকারের বিরুদ্ধে। আর এ কারণেই তাদের সঙ্গে কথা বলা, রাজনৈতিক ভাব-বিনিময় করা তাৎপর্যমণ্ডিত।’
‘তবে এই রাজনৈতিক ভাব-বিনিময়কে রাজপথে নিয়ে যাওয়ার’ ওপর গুরুত্ব দেন এমাজউদ্দীন আহমদ। তার ভাষ্য, ‘অন্তত সরকারের বিরুদ্ধে পৃথক হলেও একটি যুগপৎ অবস্থান নেওয়া খুবই দরকারি।’
জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের সম্মানে বিএনপির চেয়ারপারসন প্রতি বছরই ইফতার আয়োজন করেন। এই আয়োজন রাজনৈতিক ভাতৃত্ববোধ ছড়িয়ে দেয়।’
এদিকে বিএনপির ইফতারে জামায়াতের অন্তত ২০-২৫ জন নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে ২০ দলীয় জোট ও জোটের বাইরে। সাম্প্রতিক জোটের বৈঠকে অংশ নিলেও হঠাৎ করেই বিএনপির ইফতারে অংশগ্রহণ করার ঘটনায় বিস্মিত বিএনপি ও জোটের অনেক নেতাই। যদিও বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য না করে পর্যবেক্ষণেই বেশি মনোযোগ তাদের।
সম্প্রতি বিএনপি প্রায় সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে জামায়াতকে দূরে রেখেছে। দলীয় বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে দৃশ্যমান সম্পর্ক অনেকটাই ছিল দূরের, যদিও ৫ জুন ইফতার মাহফিল দিয়ে সম্পর্কের চিত্রপট প্রকাশ্যে এসেছে। বিএনপিপন্থী একজন বুদ্ধিজীবীর আশঙ্কা, হঠাৎ করেই জামায়াতের দৃশ্যমান হওয়ার পেছনে সরকারের রাজনৈতিক কৌশল থাকতে পারে। তারা হেফাজতকে কাছে টেনেছে।অন্যদিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির মাখামাখি আবারও সামনে এসেছে।
বিষয়টিকে এভাবে দেখতে নারাজ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি মনে করেন, ‘২০ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক রয়েছে। এর বেশি দেখা অনুচিৎ।’
/এসটিএস/ এপিএইচ/আপ-এফএস/
আরও পড়ুন-
‘আমরার ফুরি হিরিয়া জিতিবো’
বিকালে ঢাকায় গ্রেফতার, রাতে গোয়ালন্দে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত