X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনাকে রেখেই সমঝোতার পথ খুঁজছে আ. লীগ-বিএনপি

পাভেল হায়দার চৌধুরী ও সালমান তারেক শাকিল
০৮ জুলাই ২০১৭, ২২:৫৭আপডেট : ০৯ জুলাই ২০১৭, ০৮:০৩

 

শেখ হাসিনা (ফাইল ছবি: ফোকাস বাংলা) নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেখেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে চায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।এ লক্ষ্যে দল দু’টি একটি সমঝোতার কৌশলও খুঁজছে। এক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে দল দু’টি। আওয়ামী লীগ  ও বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে। তবে পরিচয় উদ্ধৃত হয়ে কোনও নেতা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

বিএনপি নেতারা বলছেন, কোনোভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবেন না তারা। খালেদা জিয়ার আসন্ন সহায়ক সরকারের প্রস্তাবনায় দশম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি থাকতে পারে। আর এটি মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলেও। তাদের মতে, সংসদ ভেঙে দিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা অক্ষুণ্ন থাকবে।

তবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মত দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। তাদের যুক্তি, সংসদ ভেঙে দিয়ে যদি নির্বাচনের দিকে আওয়ামী লীগ যায়, তাহলে মাঠের নেতাদের মনোবল ভেঙে যাবে। ভোটের আগেই নৈতিক পরাজয় ঘটবে।

সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন হবে, ক্ষমতাসীন দলের অনড় অবস্থানের কারণে ইতোমধ্যেই বিএনপির উপলব্ধি এই মুহূর্তে সংবিধানের মধ্যে থেকেই নির্বাচনে যেতে হবে তাদের। তবে আন্দোলনের কথাও ক্ষীণস্বরে বলছেন তারা। সংবিধান থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে, এ নিয়ে কৌশল নির্ধারণ করতে মরিয়া দলটি। গত ১ জুলাই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যও ইঙ্গিতবহ। ওইদিন এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে সহায়ক সরকারের অধীনে, যেখানে এই সরকারের কোনও ভূমিকা থাকবে না।’

সংবিধানের ৫৭ ধারার ৩ উপধারায় বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনও কিছুই অযোগ্য করিবে না।’  অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ততক্ষণ পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকলে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনিই ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। আর এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগের কোনও কোনও নেতা সংসদ ভেঙে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংবিধান সম্মতভাবে আগামী নির্বাচন হবে। এক্ষেত্রে কোনও আপস হবে না। সংবিধানসম্মত মানে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন। এ নিয়মকে আমরা ধরে রাখব।’

এদিকে ‘সংবিধানের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এই সংবিধানে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল না?’ এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের ইচ্ছাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে ১৯৯১ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে দিয়ে প্রধান করে নির্বাচন করা হয়েছিল, সেভাবে এবারও হবে।’ তার ভাষ্য, ‘সরকার চাইলে পারবে, সংবিধান সংশোধন করবে।’

সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে দুই দলের সমঝোতা সম্পর্কে জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ‘এটাও সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। আমরা নির্বাচনে যেতে চাই, আমাদের নির্বাচনে আনাও সরকারের দায়িত্ব।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষমতাসীন দলের দুই শীর্ষনেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সমঝোতা হতে পারে সংসদের মেয়াদ শেষের পূর্ববর্তী তিন মাস আগে নয়, তিন মাস পরে নির্বাচন হবে, তা নিয়েই। কারণ পরবর্তী তিন মাস পরে নির্বাচন হলে সংসদ থাকবে না, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা থাকবে ঠিকই। সংসদ থাকবে না সংবিধানের ভেতরে থাকা এই অনুচ্ছেদ নিয়ে হয়ত ছাড় দেওয়া-নেওয়ার একটি পরিবেশ তখন তৈরি হতে পারে।’  

প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ এ বলা আছে, সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।

(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং

 (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনও কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।

 এ বিষয়ে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ‘সংবিধানের মধ্যে থেকেই একাধিক প্রস্তাব তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। সংবিধানের ১২৩-এর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ অবসানের আগে ও পরে দু’ভাবেই নির্বাচন করার সুযোগ আছে। বিএনপি ওই ধারাই পর্যালোচনা করে দেখছে।

ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা বলেন, ‘‘বিএনপির সহায়ক সরকারের প্রস্তাব সংবিধান মেনেই দিতে হবে। তারা যদি মনে করে, সেটাই সহায়ক সরকার তার অধীনে নির্বাচনে আসবে তাতে ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ বিএনপিকে।’’

নীতি-নির্ধারকরা আরও বলছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রস্তাব হলো সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। আর সংবিধানের ভেতরে থেকে নির্বাচন হওয়া মানেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী নির্বাচন। নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, সংবিধানের মধ্যে থেকে যদি সমঝোতা সুযোগ থাকে সেক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা আওয়ামী লীগের ভেতরে রয়েছে। আর এটা মেনে বিএনপি নির্বাচনে এলে অন্য বিষয়গুলো সমাঝোতার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সহায়ক সরকারের নামে সংবিধান ও শেখ হাসিনার বাইরে গিয়ে সহায়ক সরকারের নামে অনড় থাকলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে সরকার কোনও পদক্ষেপ নেবে না।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংবিধানসম্মতভাবেই নির্বাচন হবে, এটাই থাকবে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব। এর বাইরে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে আর কোনও প্রস্তাব নেই, থাকবেও না।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘সংবিধান সম্মতভাবে শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। বিএনপি যদি এই নিয়মে নির্বাচনে আসতে রাজি হয়, সেটাকে তারা সহায়ক সরকার নাম দিতে পারে।’

বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনাকে রেখেই নির্বাচনের বিষয়টিকে না বললেও ভেতরে-ভেতরে তাকে মেনে নিয়েই প্রস্তুতি চলছে। এর বাইরে বিএনপির সামনে আপাতত কোনও বাস্তবতা নেই বলেই দলটির নেতারা মনে করেন। দলের এক প্রভাবশালী ভাইস চেয়ারম্যান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে শাশ্বত। তাদের বাদ দিয়ে কিছু চলবে না। আমরা আলোচনায় বিশ্বাসী। তবে সরকার না মানলে আন্দোলনে যেতে পারি। আর নির্বাচনে শেখ হাসিনার প্রয়োজন আছে কিনা, সেটিও ভাবা যাবে।’

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার থাকার বিষয়টি মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে স্থায়ী কমিটির প্রবীণ এক সদস্যের কথায়ও। বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশন—এই তিন বিভাগকে নিউট্রাল রোল প্লে করতে হবে। এসব বিভাগে কোন পার্টির লোক বসবে, দ্যাট ইজ ডিফারেন্স, এই তিনটি বিভাগ যদি নিউট্রাল ওয়েতে কাজ করে, তাহলে বিএনপি উইন। যেকোনও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিকে এই তিনটি পদে দেওয়া যেতে পারে। খালেদা জিয়ার হাতে থাকবে না, শেখ হাসিনারও না।  বিষয়টি দুই পার্টির জন্যই মঙ্গল।’

শেখ হাসিনাকে রেখেই সমঝোতার বিষয়ে আশাবাদী কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। আওয়ামী লীগ তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে সার্ভে করেছে। ওই সার্ভে তারা দেখেছে তাদের অবস্থা ভালো না। জনগণ  জানিয়েছে, তারা নিজেরা ভোট দিতে চায়। যে ভোট গণনা করে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। এজন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে হবে।’

এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সহায়ক সরকারের মূল কনসেপ্ট হচ্ছে দলীয় সরকারের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করা। আর আমরা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকব না। কয়েকটি প্রস্তাব দেব।’

উল্লেখ্য, বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে ফোন করে ৫টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিল।

 /এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা