বিচারপতি অপসারণে সংসদের ক্ষমতা অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের পর এই বিষয়ে পরবর্তী করণীয় কী হতে পারে তা নিয়ে ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পরই এতে নতুন কোনও নির্দেশনা দেওয়া আছে কিনা তা আগে দেখা হবে। এরপর সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
তবে ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসকের করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কোনোভাবেই আর থাকবে না বলে আভাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা ও সরকারের দু’জন মন্ত্রী। তারা জানিয়েছেন, সংসদের ক্ষমতা আপিল বিভাগ তার রায়ে অবৈধ ঘোষণা করলেও সেখানে বিকল্প কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কিনা, পুরো রায় না পড়ে তা বোঝা যাবে না। নতুন কোনও নির্দেশনা থাকলে সেটি বিবেচনায় নেওয়া হবে। এ নিয়ে আলোচনা করা হবে সংসদে। আলোচনার মাধ্যমেই নতুন পথ বের করতে হবে। তবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল বহাল রাখার কোনও নির্দেশনা থাকলে তা নিয়ে জনপ্রতিনিধিরা সংসদে সিদ্ধান্ত নেবেন।
ক্ষমতাসীন দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, নতুন আইন করার প্রয়োজন হতে পারে এমন সম্ভাবনা থেকে দল ও দলের অনুসারী অভিজ্ঞ আইনজীবীদের চিন্তা-ভাবনা করতে বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়নের আগে কোনও কোনও বিচারপতির পরামর্শও নেওয়া হবে। তারা বলছেন, ‘আপিলের রায়ে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ফেরানোর কোনও নির্দেশনা থাকলে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই নতুন পদ্ধতি ঠিক করা হবে। সেজন্য পুরো রায় হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে ক্ষমতাসীনরা। তবে এক্ষেত্রে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে অবশ্যই সামঞ্জস্য থাকতে হবে।’
উচ্চ আদালতের রায় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে বলে মন্তব্য আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুর। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উচ্চ আদালত মার্শাল-ল অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সেখানে একজন সামরিক শাসকের করা অধ্যাদেশ কিভাবে বৈধ হয়? বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে সংসদ। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদই এ বিষয়ে কী করা যায় সেই সিদ্ধান্ত নেবে। নতুন কিছু করার এখতিয়ার সংসদের রয়েছে।’
গত শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বলা হয়েছে, বিচারপতি অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদ থেকে কেড়ে নেওয়া সংক্রান্ত আদালতের দেওয়া রায় অসাংবিধানিক। সুতরাং এ ব্যাপারে নতুন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, সেই বিষয়ে সংসদ সংবিধানসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। ওই সভায় উপস্থিত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইস্যুটি নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে। এরপর নতুন কী করা যায়, তা নিয়ে কংক্রিট সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
অনেক নেতাই ইঙ্গিত দেন যে, বিচারপতি অভিশংসনের ব্যাপারে নতুন পদ্ধতি কী করা যায়, সেই সিদ্ধান্ত সংসদই নেবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে ওই নেতারা বলেন, ‘এখন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত নতুন কোনও পদ্ধতি বা আইন না হচ্ছে, ততক্ষণ কোনও জটিলতা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপতিই এর সমাধান দেবেন।’
বিচারপতি অভিশংসনের মতো দেশে কোনও জটিলতা এই মুহূর্তে তৈরি হলে সমাধানের উপায় থাকবে না বলে মত দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিচারপতি অভিশংসন বিষয়ে আপিলের সম্পূর্ণ রায় না দেখে কোনও মন্তব্য করা যাবে না। উচ্চ আদালত মার্শাল-ল অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল হয়ে গেছে। আবার আপিলের রায়ে সংসদের ক্ষমতা অবৈধ করা হয়েছে। তবে এই বিষয়ে সুপ্রিমি কোর্ট নতুন কোনও ‘ডিরেকশন’ দিয়েছেন কিনা, জানা যায়নি। এ জন্য পুরো রায় দেখতে হবে।’
সাবেক এই আইনমন্ত্রীর ভাষ্য, “রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল থাকার ব্যাপারে কোনও ‘ডিরেকশন’ দেওয়া না থাকলে অবশ্যই নতুন আইন করতে হবে। ডিরেকশন না দিয়ে যদি সংদের হাতে ক্ষমতা ও সুপ্রিম জুডিয়াশিয়াল কাউন্সিল উভয়ই সরাসরি বাতিল বলা হয়, তাহলে শূন্যতা সৃষ্টি হবে। মার্শাল-ল বাতিল করা হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও থাকার সুযোগ নেই। এখন দেখতে হবে রায়ে কী আছে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”
সংসদের হাতে ক্ষমতা বাতিল করা হলেও আপিলের রায়ে কোনও ‘ডিরেকশন’ আছে কিনা তা দেখতে হবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘রায়ের কপি পুরো দেখতে হবে। এজন্য অপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, ‘যদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রাখার পক্ষে ডিরেকশন থাকে, তাহলে সেটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। তাই আমাদের নতুন কিছু ভাবতে হবে। আর সেটা সংসদই নির্ধারণ করবে।’
আরও পড়ুন: ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে উত্তপ্ত সংসদ
/এমএনএইচ/জেএইচ/