সারাবিশ্বে সমাজতন্ত্রের নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের বামপন্থী দলগুলোর শীর্ষনেতারা। তারা মনে করেন, রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব পৃথিবীর দেশে-দেশে উদযাপিত হয়েছে এবং মানুষের মুখে-মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিশ্বজুড়ে বামপন্থী দলগুলোর ঐক্যের প্রতি জোর দিয়েছেন তারা।
শুক্রবার (১০ নভেম্বর) বিকালে রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিন দেশের বক্তারা এই আশাবাদের কথা বলেন।
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সভাপতিত্বে সেমিনারে ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআইএম) পলিটব্যুরোর সদস্য বৃন্দা কারাত, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রবোধ পান্ডে, নেপালের ইউএমএল নেতা বিজয় বাহাদুর কুনার অংশ নেন।
রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে সেনিমারে সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো সমকালীন পুঁজিবাদ ও অক্টোবর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রবোধ পান্ডে বলেন, ‘সারাবিশ্বে মানুষের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি আমেরিকার বুকেও এ আন্দোলন বাড়ছে।’ বিশ্ব নতুন এক সম্ভাবনার দিকে যাচ্ছে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন ভারতের এই বামপন্থী নেতা। তবে তিনি এও বলেন, ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আপনা-আপনি বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাস্তব হবে না। এজন্য পার্টি গড়ে তুলতে হবে। সারাদুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তার পর্যবেক্ষণ, পরিস্থিতি এত সহজ নয় এবং দুর্বলও নয়।’
প্রবোধ পান্ডে আরও বলেন, ‘এটা খুবই আশার কথা যে, অক্টোবর বিপ্লব সারা পৃথিবীতে পালিত হচ্ছে। ভারতসহ প্রত্যেকটি দেশেই বাম নেতারা শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন, মার্কসবাদের কথা বলেছেন। কেউই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি।’
পুঁজিবাদের সমালোচনা করে ভারতের এই বামপন্থী নেতা বলেন, ‘লগ্নিপুঁজি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আমেরিকা ভেবে চলেছে তারা এককেন্দ্রিক বিশ্ব গড়ে তুলবে।’ কিন্তু তা হচ্ছে না জানিয়ে প্রবোধ পান্ডে বলেন, ‘বিরোধের পর বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে পৃথিবীতে। পুঁজি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। দারিদ্র্য বাড়ছে। সারাদুনিয়া পুঁজির জালে আটকা পড়েছে।’ এই জাল থেকে বেরুবে কী করে বলেও প্রশ্ন করেন ঢাকা সফরে আসা ভারতের এই বাম রাজনীতিক। সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭৪ বছরের সমাজতান্ত্রিক শাসনামলে পৃথিবীকে যা দিয়েছে, ৩০০ বছরের পুঁজিবাদ তা দিতে পারেনি বলে দাবি করেন প্রবোধ পান্ডে।
প্রবোধ পান্ডে দাবি করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার সাম্প্রদায়িকতা রফতানি করছে, এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে এখানে। উভয় সরকার মিলে সাম্প্রদায়িকতা রফতানি করছে।
ভারতের সিপিআইএম পলিটব্যুরোর সদস্য বৃন্দা কারাত বলেন, ‘ভারতে শত বছরের বহুত্ববাদকে ধ্বংস করার পরিকল্পনায় নেমেছে সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকার। তারা ধর্মের নামে, শ্রেণি বৈষম্যের নামে, সমাজের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে ভারত শুধু নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় এই বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে।’
বৃন্দা কারাত ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, দেশটির সরকার কমিউনিস্ট দলগুলোকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তিনি এসময় ভারতে বামদলগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে হলে জনগণের মাঝে ফিরে যেতে হবে।’
বিশ্বে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হচ্ছে জানিয়ে বৃন্দা কারাত বলেন, ‘তাদের শ্রেণিচরিত্র বুঝতে হবে। একইসঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলোকে অনুধাবন করতে হবে।’
বামদলগুলোর ঐক্যের প্রতি জোর দিয়ে ভারতের সিপিআইএম নেতা বৃন্দা কারাত বলেন, ‘কোন ভিত্তিতে ঐক্য হবে তার কৌশল ঠিক করতে হবে। সমাজের মৌলবাদ দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। তাদের রুখতে বামপন্থী সব শক্তিকে এক হতে হবে।’
নেপালের ইউএমএল নেতা বিজয় বাহাদুর কুনার তার দেশের বাম আন্দোলনের সফলতার ইতিহাস তুলে ধরেন। তার ভাষ্য, ‘বাম আন্দোলনকে সফল হতে হলে এই মতাদর্শের সবগুলো দলকে একই প্লাটফরমে আসতে হবে।’
নিজের প্রবন্ধে হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ‘সারাবিশ্ব এখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এজেন্ডায় চলে এসেছে। তার জন্য বস্তুগত পরিস্থিতি খুবিই পরিপক্ক।’ বিপ্লব বিলম্বিত হচ্ছে- এর কারণ দেখিয়ে রনো তার প্রবন্ধে বলেন, ‘আমরা সাবজেক্টিভ প্রস্তুতির দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছি।’ বস্তুগত বিকাশের দিক দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ক্ষয়িষ্ণু বলেও মন্তব্য করেন প্রবীণ এই বাম তাত্ত্বিক।
সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন সিপিবি’র কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক, কামাল লোহানী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক সাইফুল হক।
আরও পড়ুন:
রোহিঙ্গা এতিম শিশুর সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে