রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরি রুট। তবে ব্যস্ততম এ রুটে চলাচলকারী ফেরিগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। বিকল্প কোনও উপায় না থাকায় লক্কর ঝক্কর ফেরিতেই চলছে পদ্মা পারাপার। মেয়াদ শেষ হওয়া যাওয়ার পরও জোড়াতালি দিয়ে কয়েকটি ফেরি চলছে। যে কোনও সময় এগুলো অকেজো হওয়ার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি ভয় রয়েছে সামনে বর্ষায় ভোগান্তির।
রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটকে বলা হয়ে থাকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার। দিন-রাত হাজার হাজার যাত্রী ও যানবাহন পারাপারে ব্যস্ত সময় পার করছে ১৬টি ফেরি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) তত্ত্বাবধানে এসব ফেরি চলছে। তবে বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত ফেরিগুলো মাঝে মধ্যেই বিকল হয়ে পরে। ফেরি ঘাটে, এমনকি মাঝ নদীতে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকা পড়ে। এর জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। ঠিকঠাক মতো দেখভাল না হওয়ায় আর মেয়াদকাল পার হওয়ায় ফেরিগুলোর সমস্যা দিন দিন বাড়ছে বলে অভিযোগ এ রুটে চলাচল করা যানবাহন চালকদের।
ঢাকা থেকে ঝিনাইদহগামী ট্রাকচালক মো. অভি হোসেন বলেন, ‘আজ প্রায় আট বছর ট্রাক চালাচ্ছি। অনেক দিন ধরেই দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরিতে ট্রাক পারাপার করি। ফেরিগুলো খুব ধীরে চলে। সময় বেশি লাগে। ফেরিতে টয়লেট সমস্যটা অনেক বেশি কষ্টকর। তেমন সুযোগ-সুবিধাও নাই।’
কুষ্টিয়া থেকে চট্রগ্রামগামী পণ্য বোঝাই ট্রাক চালক মো. আসিফ মোল্লা বলেন, ‘দৌলতদিয়া ঘাটে আসলে ফেরিতে সিরিয়াল না মেলাটাই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দৌলতদিয়ার রাস্তায়, নয়তো টার্মিনালে অপেক্ষা করতে হয়। কখনও কখনও এক দুই দিনেও ফেরিত উঠতে পারি না। এতে ট্রাক চালক ও হেলপারদের খুব কষ্ট হয়।’
কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী পণ্য বোঝাই ট্রাক চালক মো. শাহাবুল মোল্লা বলেন, ‘দৌলতদিয়া ঘাটে আসলেই শোনা যায় ফেরি সংকট। ফেরিতে ট্রাক উঠাতে দালালের সাহায্য লাগে। দালালের প্রস্তাবে রাজি হলে দ্রুত মেলে ফেরির সিরিয়াল।’
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে চলাচলকৃত রো রো ফেরি শাহ জালাল এর মাস্টার মো. হাসমত আলী জানান, ‘রো রো ফেরি শাহ জালাল এর বয়স প্রায় ৩৮ বছরের মতো। ফেরিটি ডেনমার্কের তৈরি। মাঝে মধ্যেই ফেরিতে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়। তখন ফেরিটি মধুমতিতে নিয়ে গেলে সংস্কার করে আনা হয়। রো রো ফেরি চলতে প্রায় ১০ ফিট পানির প্রয়োজন হয়। নদীতে ভাটির সময়ে ফেরি চলাচল করতে কিছুটা সমস্যার সম্মুখিন হই। সরু চ্যানেলে ফেরি প্রবেশ করলে ফেরি চলতে কষ্ট হয়। এছারা ভারী পণ্য বোঝাই ট্রাক বেশি লোড হলে কিছুটা সময় বেশি লেগে যায়।’
রো রো ফেরি ভাষা শহীদ বরকত এর ফেরি মাস্টার শৈশব চন্দ্র দে জানান, ‘রো রো ফেরি ভাষা শহীদ বরকত ১৯৯৩ সালে তৈরি করে ডেনমার্ক। ফেরিগুলো তো তাদের মেয়াদকাল পার করেছে। এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় ভালোই চলে। তবুও মাঝে মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়। নদীতে পানি কমে গেলে বা বর্ষায় পানি যখন বেড়ে যায় তখন তীব্র স্রোতে ফেরি চালাতে সমস্যা হয়। তবে ফেরিগুলোর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। ফেরিগুলোতে জিপিআরএস, রার্ডার সংযোজন করা হলে ফেরি চালাতে আরও সুবিধা হতো। বড় আকৃতির ফেরিগুলোতে যাত্রীদের বসা বা টয়লেটের ব্যবস্থা থাকলেও ছোট আকৃতির ফেরিগুলোয় তা একেবারেই কম। ফলে যাত্রীদের কিছুটা সমস্যা হয়।’
রো রো ফেরি শাহ জালালের যানবাহন লোড-আনলোডের দায়িত্বে থাকা মো. নুরুল আমিন চৌধুরী জানান, ‘ফেরিগুলো যখন ডেনমার্ক থেকে আসে, এরপর আর কোনোদিনই ফেরিতে নতুন করে জেনারেটর দেওয়া হয় নাই। এখন এই পুরাতনগুলোই সংস্কার করে লাইন চালু রাখছি। নতুন করে যদি বিআইডব্লিইটিসি ম্যানেজমেন্ট উদ্যোগ নেয় তাহলে অনেক ভালোভাবে ফেরিগুলো চলাচল করতে পারবে।’
ফেরিগুলোর বেহাল দশার কথা স্বীকার করে বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাটে দায়িত্বরত ম্যানেজার (বাণিজ্য) জানান, ‘দৌলতদিয়া পাটুরিয়া নৌরুটে চলাচলকৃত ফেরিগুলো আসলেই অনেক পুরানো দিনের ফেরি। আমরা জানি পানিতে যে সব যানবাহন ও ক্যাবগুলো চলে তা উন্নত দেশে ২০ বছর পরই গলিয়ে ফেলে। আর আমাদের ফেরীগুলো ৩৫ থেকে ৩৮ বছরের মতো বয়স হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে রাতে দুই তিনটি ফেরি বন্ধ থাকে। যার জন্য কিছুটা গাড়ির সিরিয়াল হয়। তীব্র স্রোতে, প্রবল ঝড়সহ সামনে একটা ফ্যাক্টর আছে। যতদূর সম্ভব এর মধ্য দিয়েই আমাদের চলতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপরে তো আর কারও হাত নেই।’