তিন বছর মেয়াদি বিএনপির অঙ্গ সংগঠন যুবদলের কমিটির মেয়াদের প্রায় দুই বছর শেষ হয়ে গেলেও এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। গত ১৯ মাস ধরে ৫ সদস্যের আংশিক কমিটি দিয়ে কোনভাবে চলেছে যুবদলের সাংগঠনিক কার্যক্রম। সংগঠনটির সাংগঠনিক অবস্থা এতোই নাজুক যে কার্যালয় খোলার মতো লোকও নেই। আবার ৫ সদস্যের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক ৪ মাস ধরে কারাগারে বন্দি। এদিকে কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ না করলেও সারাদেশের জেলা কমিটি দিচ্ছে আংশিক কমিটির নেতারা। তবে অভিযোগ রয়েছে টাকা বিনিময়ে অধিকাংশ জেলা কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের পদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে জেলা কমিটিগুলো হওয়ার পরে বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ, কার্যালয়ে তালা দেওয়া এবং কমিটি থেকে পদত্যাগের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি ৩ বছরের জন্য যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে কমিটি ঘোষণা হয় আংশিকভাবে। মাত্র পাঁচ জন সদস্যের নাম ঘোষনা করা এই আংশিক কমিটিতে সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি এবং সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। আর সিনিয়র সহ-সভাপতি করা হয় মোর্ত্তাজুল করিম বাদরুকে। কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান নুরুল ইসলাম নয়ন আর সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন মামুন হাসান। কিন্তু, সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির কাজটি করতে পারেননি তারা। এরমধ্যে ১২ জুন থেকে কারাগারে আছেন সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু আর ১৩ জুলাই থেকে কারাগারে বন্দি মামুন হাসান।
কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে ৫ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণার সময় এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশ থাকলেও ১৯ মাসেও তা করতে পারেননি তারা। আংশিক কমিটির নেতারা বলছেন, যুবদলের কমিটি হওয়ার পরে প্রতি সপ্তাহে বিএনপির চেয়ারপারসনকে সপ্তাহে ৩ দিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তখন নেতাকর্মীদের আদালতে আসা-যাওয়ার পথে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এরপর দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পরে আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে। এই কারণে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা যায়নি। এর মধ্যে সারাদেশের জেলা কমিটি গঠন করতে হয়েছে। তবে খুব শিগগিরিই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে।
যু্বদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ আমাদের কমিটি গঠনের পরে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া সপ্তাহে ৩ দিন মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে গিয়েছেন। ওই সময় নেতাকর্মীদের সেখানে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এখন তার মুক্তি আন্দোলনে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে আমরা সারাদেশের জেলা কমিটি ঘোষণা করেছি। তাই কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ গঠন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া জেলা কমিটির করার পরে কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে হয়, কারণ যারা জেলা কমিটিতে স্থান পাবেন না তাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরোয়াভাবেও রাজনৈতিক আলোচনা, বৈঠক করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন ধরনের মামলা দেওয়া হচ্ছে। ৫ জন বসে যে কমিটি গঠন করবো সেই সুযোগ নেই। তবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মুক্তি পেলে খুব শিগগিরই কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হবে।
এদিকে কমিটি পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে যুবদলের পদ প্রত্যাশী নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ার পেছনে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বড় কারণ। তারা প্রত্যেকে নিজের পছন্দের লোকদের কমিটিতে স্থান দিতে চান। এই কারণে ১৯ মাসেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেননি তারা।
যুবদলের সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রদলের সভাপতি থাকাবস্থায় সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নিজস্ব একটি বলয় ছিল। তিনি চান সেইসব নেতাকর্মীকে যুবদলের পদ দিতে। অন্যদিকে, যুবদলের আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় সাইফুল আলম নীরবও একটি নিজস্ব বলয় গড়ে তুলেছিলেন। এখন তিনি চাইছেন তার আস্থাভাজনদের কমিটিতে পদ দিতে। এই দুইজনের দ্বন্দ্বের কারণে কমিটির মেয়াদ শেষের পথে থাকলেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা সম্ভব হয়নি। এই কারণে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চতুর্থ তলায় যুবদলের কার্যালয়ে থাকলেও দিনের পর দিন তা বন্ধ রয়েছে। অফিস খোলার মতো লোকও নেই। গত ২৫ ও ২৬ অক্টোবর যুবদলের কার্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে।
তবে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব কমিটি গঠনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘যারা যুবদল শক্তিশালী হোক চায় না তারা এসব কথা বলে বেড়াচ্ছে। আমাদের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। সরকারের এত নির্যাতনের পরও যুবদল বসে নেই। সরকারের প্রতিটি বাধা ও সৃষ্ট প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে রাজপথের কর্মসূচিতে যুবদল ভূমিকা রাখছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবদলের এক নেতা বলেন, ‘ যুবদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংগঠনের চাইতে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। উভয়েরই একাধিক ব্যবসা রয়েছে। তারা ঢাকা শহরে গাড়ি-বাড়ির মালিক। যার কারণে বর্তমানে যুবদলের সাংগঠনিক কার্যক্রম শোচনীয়। সংগঠনের অফিস খোলার মতো নেতাও নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘জেলা কমিটি গঠনে টাকা আছে, তাই ঘরে বসেই প্রেস রিলিজের মাধ্যমে তারা কমিটি দিয়ে দিচ্ছে।’
যুবদলে পদপ্রত্যাশী এক নেতা বলেন, ‘পদের আশায় নিজের টাকা ও পুলিশের হামলা-মামলা মাথায় নিয়েও আন্দোলন করি। কিন্তু মাসের পরে মাস যায় কমিটি হয় না। তাহলে এতো নির্যাতন সহ্য করে আন্দোলন করে আমাদের লাভ কী? অথচ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য করছে, পাশাপাশি পদ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা বানিয়ে নিচ্ছে।’
যুবদলের ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক কামরুজ্জামান দুলাল জানান, ‘সারাদেশে যুবদলের ৮২ টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এরমধ্যে ৬২ টি সাংগঠনিক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। এছাড়া সিলেট জেলা ও মহানগর ছাড়া বাকি সব জায়গায় আংশিক ও আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে।’
এদিকে জেলা কমিটিগুলোতে টাকার বিনিময়ে পদ দেওয়ার অভিযোগ উঠছে কেন্দ্রীয় যুবদলের নেতাদের বিরুদ্ধে। গত ৪ জুন ভোলায় জেলা যুবদলের কমিটি ঘোষণা করা হলে তা বাতিলের দাবিতে ঝাড়ু মিছিল করেছে জেলা যুবদলের পদবঞ্চিত গ্রুপ। ওই সময় যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম কায়েদ বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি গঠন না করে অর্থের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় নেতারা কমিটি দিয়েছেন। যাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে তাদের কেউ আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে ছিলেন না।’
এর আগে ১ জুন নীলফামারী জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক এএইচএম সাইফুল্লাহ রুবেলকে সভাপতি ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহদাৎ হোসেন চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা যুবদলের ৫ সদস্যের কমিটি করা হলে তা প্রত্যাখ্যান করে পদত্যাগ করে সিনিয়র সহ-সভাপতি, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাংগঠনিক সম্পাদক। এ সময় তারা স্থানীয় বিএনপির কার্যালয়ে তালাও দেয়। পরে সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘ঘোষিত কমিটির সভাপতি এএইচএম সাইফুল্লাহ রুবেল জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক। একজন বিএনপি নেতা কীভাবে জেলা যুবদলের সভাপতির দায়িত্ব পান? ওই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে আমিসহ তিনজন পদত্যাগ করেছি। এই রকম ঘটনা ঘটে বগুড়াসহ বেশকিছু জেলায়।’
এদিকে গত ২২ সেপ্টেম্বর ফেনী জেলা যুবদলের কমিটিতে জাকির হোসেন জসিমকে সভাপতি, নাছির উদ্দিন খন্দকারকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। ফেনী যুবদলের এক নেতা বলেন, ‘৫ লাখ টাকার বিনিময়ে জাকির হোসেন জসিম যুবদলের সভাপতি হয়েছে।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন যুবদলের সভাপিত নীরব। তিনি বলেন, কমিটিতে পদ না পেয়ে কেউ কেউ এ ধরনের অভিযোগ করছে।
যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, টাকার বিনিময় কোনও কমিটি দেওয়া হয়নি। যারা যোগ্য তাদের কমিটিতে পদ দেওয়া হয়েছে।