X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের প্রার্থীদের ধানের শীষ প্রতীক দেওয়ায় ঐক্যফ্রন্টে সন্দেহ

সালমান তারেক শাকিল ও আদিত্য রিমন
০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ২২:২১আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:২৫

জামায়াতের প্রার্থীদের ধানের শীষ প্রতীক দেওয়ায় ঐক্যফ্রন্টে সন্দেহ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রায় ২৫ জন প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীকে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়ায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। জোটটির শীর্ষ নেতাদের একটি বড় অংশের সন্দেহ, জামায়াতের প্রার্থীদের ধানের শীষ প্রতীক দেওয়ার মধ্য দিয়ে দুই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি। এর পেছনে বিএনপির হাইকমান্ডের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেন ঐক্যফ্রন্টের কোনও কোনও দায়িত্বশীল নেতা।

ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমত, জামায়াতের প্রার্থীদের বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের সামনে নতুন ইস্যু ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা দেশসহ আশপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে বিএনপির যে প্রচারণা এতদিন ছিল, তা ভেস্তে যাবে। আর এই প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার পেছনে বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশনা থাকলেও নেতৃত্বের ‘কার্যকর’ অংশটি চায় জামায়াতকে ধানের শীষ না দেওয়া হোক। যদিও প্রতীক বাতিল করে দিতে আগামী ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক জটিলতাও আছে বলে নেতারা জানিয়েছেন। জামায়াতের সঙ্গে তৈরি হবে নতুন সংকট।

যদিও ঐক্যফ্রন্টের কোনও কোনও নেতা মনে করছেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে যেকোনও ধরনের ‘স্যাবোটাজ’ এড়াতে জামায়াতের সঙ্গে এ বিষয়ে আপস করে নেওয়াটাই ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশলের জন্য ইতিবাচক। এ বিষয়ে ফ্রন্টের নেতারা সরাসরি মন্তব্য করতে নারাজ।

জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দিতে গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জোরালো আপত্তি থাকলেও বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের কনভিন্স করা হয়। যদিও বিএনপির বক্তব্যে সায় দিলেও তাদের আপত্তি এখন সন্দেহে রূপ নিয়েছে। ফ্রন্টের একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, স্টিয়ারিং কমিটির সামনের বৈঠকেই বিষয়টি উত্থাপন করা হবে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা- এসব আমাদের মৌলিক জিনিস। এসবে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের মনোনয়ন কোনোভাবেই দেওয়া ঠিক হবে না। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম—দুটি পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান আছে। সেক্ষেত্রে এটা বলা যায়, সরকার চাইলেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারতো, কিন্তু করেনি। তাদের নিয়ে রাজনীতিতে গেম আছে। জামায়াতকে তো অনেকেই মডারেট ইসলামি দল হিসেবে চেনে’। এক প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘প্রতীক দেওয়ায় খুব সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি শরিক দলের একজন শীর্ষ নেতা মনে করেন, ‘জামায়াতের যে ২৫ জনকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছে, এরমধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর হচ্ছে ঢাকা-১৫ আসন। রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এই আসনে অবস্থান করায় এই আসনেই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানকে ধানের শীষে মনোনয়ন দেওয়ায় সন্দেহ আরও দানা বেঁধেছে।’

জামায়াতের প্রার্থীদের ধানের শীষে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি অবশ্য বিএনপি একাধিকবার ব্যাখ্যা করেছে। ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান নজরুল ইসলাম খান গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘জামায়াতের সবাই মানবতাবিরোধী অপরাধী নয়। জামায়াতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও আছে। জামায়াত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হলেও কোনও মানবতাবিরোধী অপরাধীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। হবেও না। আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কোনও মানবতাবিরোধী অপরাধীকে ধানের শীষ দেওয়া হবে না।’ এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘জামায়াতের কোনও প্রার্থী নেই, সব ধানের শীষ।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম এক নেতা মনে করেন, ‘পুরো প্রক্রিয়া স্যাবোটাজ করতেই জামায়াতের নেতাদের ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছে।’

কী কারণে তারা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে, এ বিষয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে অবশ্যই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনকে দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘ধানের শীষ প্রতীক নিয়েছি, এটা তো নির্বাচনের জন্য একটা আইন। আমরা বিএনপির সঙ্গে জোট করেছি, নির্বাচন করছি। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে চলেছি। এতে করে দলীয় অস্তিত্ব, দলীয় স্বাতন্ত্র্য, দলের আদর্শ, দলের সদস্যপদ কেটে যায়নি। এখানে তো ওই আইন নেই, এক্ষেত্রে এটা নির্বাচনি আইন। একটি নিবন্ধিত দলের সঙ্গে জোটে থাকার ক্ষেত্রে এই আইন মানতে হচ্ছে। তাতে করে দলীয় সংবিধান, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য লঙ্ঘিত হচ্ছে না। আমাদের দল আছে, এটা নির্বাচনি রাজনীতির জোট একটা, সে হিসেবে এখানে কোনও সমস্যা নেই।’

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জামায়াতকে সরকার চাইলে নিষিদ্ধ করতে পারতো, কিন্তু তারা করেনি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের হাতে ফুল দিয়ে জামায়াতের ৫ শতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। এছাড়া এখন জামায়াত নামে কোনও দল নেই। জামায়াতকে বিএনপি দাড়িপাল্লায় মনোনয়ন দেয়নি, তারা ধানের শীষে মনোনয়ন দিয়েছে। সুতরাং তারা এখন বিএনপির প্রার্থী, জামায়াতের নয়।’

এক প্রশ্নের জবাবে মন্টু বলেন, ‘জামায়াতে বিএনপি না, বিএনপির মধ্যে জামায়াত বিলীন হয়ে যাচ্ছে, এটা তাদের বিষয়। যেহেতু আমরা বিএনপির জোটের শরিক নই, তাই এটা বিএনপি ভালো বলতে পারবো কেন তারা জামায়াত নেতাদের ধানের শীষের মনোনয়ন দিয়েছে।’

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার বলেন, ‘দেশে এখন জামায়াত নামে দৃশ্যমান কোনও দল নেই বলে আমরা বিবেচনা করি। তবে জামায়াত নেতারা তো দেশের বৈধ নাগরিক নাকি? তাদের তো নিষিদ্ধ করা হয়নি। আর বিএনপি কাকে ধানের শীষের প্রতীক দেবে, এটা তাদের বিষয়। এখানে আমাদের কিছু বলা নেই। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী বা জামায়াতের কোনও সম্পর্ক নেই।

গত ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মার্কিন কংগ্রেসে মৌলবাদী সংগঠন জামায়াত ও শিবিরকে দেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য চলমান হুমকি উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারকে তাদের রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে।’

ঐক্যফ্রন্টের কোনও কোনও নেতা এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখলেও বিএনপির কাছে তা পাত্তা পায়নি। বিষয়টি সম্পর্কে জামায়াতও তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। দলটির প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনিম আলম গণমাধ্যমে বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘উল্লিখিত শিরোনামে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১৫ সালে অনুরূপ একটি বিল মার্কিন কংগ্রেসের কমিটিতে জমা দিলে বাছাই কমিটি তা বাতিল করে দেয়। ফলে তা কংগ্রেসে উত্থাপিত হয়নি। তিন বছর পর ২০ নভেম্বর ২০১৮ জনৈক কংগ্রেসম্যান কর্তৃক একই ধরনের বিল কংগ্রেসে উত্থাপনের উদ্দেশ্যে কমিটিতে জমা দেওয়া হয়। এবারের এই বিলে ৫৩৪ জন কংগ্রেসম্যানের মধ্যে মাত্র একজন কংগ্রেসম্যান সমর্থন করেছে। একই ধরনের মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যের কারণে এবারও বাছাই কমিটিতে এই বিল প্রত্যাখ্যাত হবে।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির দু’জন সদস্য বলছেন, ‘প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার নামে মূলত জামায়াতকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করেছে বিএনপি। এতে করে দেশে ও দেশের বাইরে পর্যাপ্ত সমালোচনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। দলের বর্তমান কার্যকর নেতৃত্বে জামায়াতের বিষয়ে নেতিবাচক থাকলেও কেন শেষ মুহূর্তে প্রতীক দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বিস্ময়কর। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ফ্রন্টের নেতাদের কাছে বিএনপির প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে কনভিন্স করানো হয়েছে। বিষয়টি কনভিন্সের নয়, ভবিষ্যতের প্রশ্ন। এই মুহূর্তে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছে দুটি রাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এই প্রতীক বরাদ্দের কারণে। যদিও ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় আছে, তাদের বাতিল করার।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ইশতেহার কমিটির প্রধান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জামায়াতের নেতারা ধর্মত্যাগ করেছেন, তাই মার্কা দেওয়া হয়েছে। এতে সমস্যার কিছু নেই।’ একাত্তরের বিষয়ে তারা নিশ্চয়ই ক্ষমা চাইবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

/এমএনএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না