X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্ত বিএনপি, কেন্দ্র না তৃণমূল!

আদিত্য রিমন
০৬ মার্চ ২০১৯, ১৭:১৭আপডেট : ০৬ মার্চ ২০১৯, ১৮:১৮

বিএনপি

 

আসন্ন উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। কিন্তু বেশিরভাগ উপজেলায় কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করেছেন দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তারা অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় গত কয়েকদিনে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের তিন শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই বিভ্রান্তির স্রষ্টা কে, কেন্দ্র নাকি তৃণমূল?
তৃণমূল নেতারা বলছেন, তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না। জিতে আসলে কেন্দ্র তাদের ওপর থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করে পারবে না। কেন্দ্রের এই যে নির্বাচন বর্জন ও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত, আবার তৃণমূল নেতাদের অনড় অবস্থান— এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর উপজেলা নির্বাচন নিয়ে এটা বিএনপির নতুন কোনও কৌশল কিনা? অর্থাৎ, নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়া তৃণমূল প্রার্থীদের বহিষ্কার, আবার জিতে আসলে তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলেও এটা রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। বেশিরভাগ বহিষ্কৃত নেতা মনে করেন—তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। বিএনপির এক সিনিয়র নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এটা হতে পারে সরকারকে চাপে রাখার জন্য হাইকমান্ডের একটা কৌশল।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কেন্দ্রের চেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন তৃণমূল নেতারা। তারা তখন বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। আর এখন দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তারাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ কৌশলী জবাব দেন। তারা বলছেন, তৃণমূল নির্বাচনমুখী। তাদের নির্বাচন থেকে বিরত থাকা অসম্ভব। এটা করলে দলের কাঠামো ভেঙে পড়বে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয় না, তার বড় প্রমাণ ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ২৯ ডিসেম্বর রাতে ভোট হয়েছে। ফলে এই সরকারের অধীনে আর কোনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তৃণমূলের সাংগঠনিক কাঠামোতে এর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বহিষ্কৃতরা যদি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, বা পরে তাদের ভুল বুঝতে পেরে দলে ফেরার আবেদন করেন, তাহলে আমরা তা বিবেচনা করবো।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তৃণমূল রাজনীতির ভিত্তি মজবুত হয়। দলের সাংগঠনিক সক্ষমতাও বাড়ে। আগ্রহী নেতাদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে মৌন সম্মতি রয়েছে দলের হাইকমান্ডের। ফলে বহিষ্কৃতদের পরবর্তীতে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তবে সে ক্ষেত্রে যারা দলের প্রতি অনুগত, দলীয় নেতাকর্মীদের বিপদে-আপদে পাশে থাকেন, তারা ভুল স্বীকার করে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করলে তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
বগুড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় ৩২ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চাঁন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তৃণমূলের সিদ্ধান্ত ছিল—খালেদা জিয়াকে ছাড়া এই সরকারের অধীনে নির্বাচন অংশগ্রহণ না করা। কিন্তু তৃণমূলের সিদ্ধান্ত যা-ই থাকুক না কেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত সবাইকে মেনে নিতে হবে। এখন যারা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন, আমরা তাদের বহিষ্কার করেছি।’
তিনি বলেন, ‘তাদের আবারও দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে কিনা তা জানি না। যারা কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন, তারা দলের স্বার্থবিরোধী প্রলোভনে বিভ্রান্ত হয়েছেন আমি মনে করি।’
উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় বহিষ্কার হয়েছেন বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি বিউটি বেগম। এর আগে তিনি এই উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এবার তিনি চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বিউটি বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই উপজেলার ৮০ ভাগ লোক বিএনপির সমর্থক। তাদের তো একজন প্রতিনিধি দরকার। এজন্যই আমি নির্বাচন করছি। আমি বিএনপি করি, আগামীতেও বিএনপি করবো। দেখা যাক দল পরবর্তীতে কী সিদ্ধান্ত নেয়।’
বগুড়া সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন মাফতুন আহমেদ খান রুবেল। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) মুক্ত না করে এই সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য কেন্দ্রকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, এটা ঠিক। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। যারা নির্বাচনে যাবেন দল তাদের পদত্যাগ করতে বলেছে। আমি এরইমধ্যে পদত্যাগ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘সরকার সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ভোট দেওয়ার সুযোগ না দিলেও বগুড়া সদরে ভোট দিতে পেরেছেন ভোটাররা। এ কারণে আমাদের দলের প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। নির্বাচন করতে গিয়ে নেতাকর্মীরা অনেক হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। সেই নেতাকর্মীরা এখন বলছেন, উপজেলায় আওয়ামী লীগের লোক চেয়ারম্যান হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। পরবর্তীতে দল কী পদক্ষেপ নেয়, সেটা দেখতে চাই।’
উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় বহিষ্কার হয়েছেন মাগুরা জেলা বিএনপির সদস্য ও বর্তমানে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম খান বাচ্চু। তিনি বলেন, ‘গতবারও আমি স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জিতেছি। এবার দলীয় নেতাকর্মীদের ইচ্ছায় প্রার্থী হয়েছি। দল যদি আমাকে প্রয়োজন মনে করে, তাহলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে পারে।’
একই অভিযোগে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলার ৩২ জন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনে কী হয়েছে, তারা (বহিষ্কৃতরা) বোধ হয় উপলব্ধি করতে পারেননি। আমরাও হয়তো তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। এই কারণেই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। ফলে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। এখন পরবর্তীতে দল কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা বলতে পারবো না।’
বিশ্বনাথ উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী সেলিম আহমদে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। কারণ, স্থানীয় জনগণের পরামর্শেই আমি প্রার্থী হয়েছি। এ কারণে আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে পরে দলে ফেরার জন্য আমি আবেদন করবো।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তৃণমূলের নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের চাপ দেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় তারা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘কর্মসূচি দেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি নাই কেন?’ এখন সেই নেতাকর্মীরাই কর্মসূচির কথা ভুলে গিয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির থিংকট্যাংক হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনে এত বড় পরাজয়ের পরও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি জেলার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেনি। তারা একবারও জানতে চায়নি যে, তৃণমূল বিএনপি কী চায়। তারা শুধু তারেক জিয়া কী বলবে, সেটার অপেক্ষায় বসে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে—এটা ভালো দিক। কিন্তু বিএনপির উচিত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করা। কারণ, স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল রাজনীতির ভিত্তি মজবুত হয়। এছাড়া, এই নির্বাচনে স্থানীয় নেতাদের অনেক স্বার্থ জড়িত থাকে। ফলে অনেকে নির্বাচনে যাবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা