X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুলতান মনসুরই প্রথম

আদিত্য রিমন
০৮ মার্চ ২০১৯, ২৩:২৯আপডেট : ০৯ মার্চ ২০১৯, ১৫:৪২

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ গ্রহণ ও সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরই প্রথম নজির সৃষ্টি করলেন। এর আগে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সংসদ সদস্যদের দল বদলের ঘটনা থাকলেও সুলতান মনসুরের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, এর আগে এমন ঘটনা আর  ঘটেনি।

সুলতান মনসুর গণফোরামের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-গণফোরামসহ পাঁচটি দলের সমন্বিত রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আট জন প্রার্থী বিজয়ী হলেও তারা শপথ ও সংসদে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে রয়েছেন। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এককভাবে সংসদে যোগ দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছেন কেবলমাত্র সুলতান মোহাম্মদ মনসুর।

রাজনীতিকরা বলছেন, নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদ সদস্য দলত্যাগ করেছেন ও মন্ত্রীত্ব পেয়েছেন— এমন ঘটনা দুয়েকটি রয়েছে। তবে নির্বাচিত হয়ে শপথ না নেওয়া, একই সঙ্গে সংসদে যোগ না দেওয়ার ঘটনাটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এখনও শপথ গ্রহণের বিপরীত অবস্থান ধরে রেখেছে। পাশাপাশি ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত না মেনে সংসদে যোগ দিয়ে নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর।

সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচিত কোনও সদস্য সংসদ প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠক থেকে ৯০ দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ না করলে, তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। সেই হিসাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত বাকি সাত জনের শপথ গ্রহণের সময় রয়েছে এপ্রিল পর্যন্ত। শুক্রবার (৮ মার্চ) সকালে ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, তারা এখনও শপথ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটল আছেন।

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচিত হয়ে সংসদে যোগ না দেওয়ার ঘটনার দিক থেকে এবারই প্রথম যে, আমরা শপথ নিইনি। একইসঙ্গে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শপথ গ্রহণ করার দিক থেকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের শপথ গ্রহণও প্রথম ঘটনা।’

 

ধানের শীষ হাতে নির্বাচনি প্রচারণায় সুলতান মনসুর

ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘‘১৯৫৪ সালে রাজনৈতিক দলের নেতারা সকালে-বিকালে এক দল ছেড়ে অন্যদলে চলে যেতেন। এটাকে ওই সময় বলা হতো ‘হর্স ট্রেডিং’। একদল থেকে নির্বাচিত হয়ে চলে যাচ্ছেন আরেক দলে। নির্বাচিতরা সুপ্রিম সিদ্ধান্ত মানছেন না। রাজনীতির নামে এটা অপরাজনীতি। পরে বঙ্গবন্ধু যখন সংবিধান প্রণয়নের নির্দেশ দেন, তখন ড. কামাল হোসেনকে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন— ‘সাংবিধানিকভাবে এটা বন্ধ করো।’ মূলত সে লক্ষ্যেই সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ করা হলো।’’

সুব্রত চৌধুরী প্রশ্ন করেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ কতদূর যাবে? এখন যা বলা আছে, তাতে আমার ব্যাখ্যা হচ্ছে— দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিতে পারবে না। আমি ব্যাখ্যা করছি, দলীয় সিদ্ধান্ত ভায়োলেট করে তিনি সংসদে যাচ্ছেন।  আমরা তাকে বরখাস্ত করেছি। তাহলে তিনি কোন দল থেকে নির্বাচিত? তার তো কোনও দলই নেই। ফলে তিনি ধানের শীষেরও এমপি না, আবার গণফোরামেরও না। যদিও তিনি ভোট করেছেন বিএনপির ধানের শীষ নিয়ে, গণফোরাম থেকে মনোনীত হয়ে। আমাদের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রয়োগযোগ্য। আর নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন তো আছেই।’

রাজনীতির বিশ্লেষক এবং এসময়ের আলোচিত লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ অবশ্য সুব্রত চৌধুরীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুলতান মনসুরের শপথ গ্রহণ ও সংসদে যোগ দেওয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া সব দলই তো সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের সংশোধন চায়। বিএনপিও এটা চায়। তারা তাদের নির্বাচনি ইশতেহারেও বলেছে— তারা সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের সংশোধন চায়। ফলে ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন হলে সুলতান মনসুরের এই পদক্ষেপকে সমালোচনা করা যাবে না। এটা তো (বিএনপির) এক ধরনের স্ববিরোধিতা হলো না? ’

মহিউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের অবতারণা করেন। তিনি বলেন,  ‘আমার কাছে একটা জিনিস মনে হয়েছে যে, এবার সংসদে বিরোধী দলের যারা জয়লাভ করেছেন, তারা যে জয়লাভ করবেন, এটা কি তাদের ওপরে নির্ভর ছিল? নাকি অন্য কারও ওপর? সুতরাং, সুলতান মনসুরের শপথ নিয়ে এত হৈ-চৈ করার কিছু নেই।’

একাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ২৯৮ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী দিয়েছিল। এরমধ্যে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সাত জন এবং জোটের শরিক গণফোরামের ‘উদীয়মান সূর্য’ প্রতীকে এক জন প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন রাতে এই জোটের মুখপাত্র ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করছি।’ এরপর জোটের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত কেউ শপথ গ্রহণ করবে না।’ কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) শপথ গ্রহণ করেন জোটের নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সুলতান মনসুর।  

 শপথ নিচ্ছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য— বাংলাদেশের রাজনীতিতে শৃঙ্খলা নেই, সুলতান মনসুরের শপথ গ্রহণ তারই প্রতিপ্রফল। কারও মতে, সুলতান মনসুরের মতো ঘটনা না ঘটলেও নির্বাচিত হওয়ার পর  দল ত্যাগের ঘটনা আরও  আছে।

রাজনৈতিক সাহিত্যের লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, নবম সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এম গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সদস্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বহাল ছিল। তারও আগে অষ্টম সংসদের (২০০১-২০০৬) শেষের দিকে ক্ষমতাসীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। সে ক্ষেত্রেও তার সদস্য পদ বহাল ছিল।

বাংলা ট্রিবিউনের সংসদ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এমরান হোসাইন শেখ জানান, গোলাম রেজা ও আবু হেনার ক্ষেত্রে সংসদের ব্যাখ্যা ছিল— দল থেকে তাদের বহিষ্কার করা হলেও তারা যেহেতু নিজ নিজ দল থেকে পদত্যাগ করেননি, সে কারণে সংসদে তাদের সদস্য পদ বহাল ছিল।’

রাজনীতি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিতে শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে, সুলতান মনসুরের শপথ তারই প্রতিফলন। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সেটা যে আমাদের দেশের দলগুলোর মধ্যে নেই, তারই বহিঃপ্রকাশ এই ঘটনা। ফলে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নেওয়ার মতো কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।’

লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমার জানা মতে, সুলতান মনসুর আওয়ামী লীগের লোক। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে কখনও পদত্যাগ করেন নি এবং দলও যে তাকে বহিষ্কার করেছে— এটাও আমি কখনও শুনিনি।’

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে উদ্ধৃত করে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই কথাটি মাহমুদুর রহমান মান্নার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি  আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন, বা তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে আমি জানি না। সুতরাং, মনে-প্রাণে সুলতান মনসুর আওয়ামী লীগের। কিন্তু তার কপালে সংস্কারপন্থী হিসেবে টিকা ছিল। সে কারণে তিনি দলের মধ্যে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাই কিন্তু আওয়ামী লীগে পরে পুনর্বাসিত হয়েছেন। এখন হয়তো সেভাবেই সুলতান মনসুরকে ডাকা হয়েছে। হয়তো অন্যভাবে হয়েছে, যেটা আমরা জানি না।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, সুলতান মনসুরের বিষয়ে তারা আইনগতভাবে  খোঁজখবর নিচ্ছেন। শনিবার (৯ মারচ) সকালে গণফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি এ সংক্রান্ত একটি সভাও করবে। ওই সভায়  ড্রাফট তৈরি করে আইনজীবীদের মতামত নিয়ে সংসদ বরাবর পাঠানো হবে।

গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যা করে সংসদের কাছে চিঠি পাঠাবো— সুলতান মনসুরের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করার জন্য।’

 

/এসটিএস/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে শোকজ
কুড়িগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালককে শোকজ
বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না
বিদ্যুৎ ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না
ওমরা পালনে সৌদি গেলেন পাটমন্ত্রী
ওমরা পালনে সৌদি গেলেন পাটমন্ত্রী
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা