X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপিতে কী হচ্ছে?

আদিত্য রিমন
২৭ মার্চ ২০১৯, ১৯:৫৩আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৯, ২১:১২





বিএনপি

গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যান। এরপর থেকে লন্ডনে অবস্থানরত দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের স্থায়ী কমিটির যৌথ নেতৃত্বে বিএনপি পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলটির‌ মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। প্রশ্নের মুখে পড়েছে দলীয় নেতৃত্ব।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সিদ্ধান্তে দলের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। একটি অংশ আরেকটি অংশের প্রতি ব্যর্থতার অভিযোগ করে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার দাবি পর্যন্ত ‍তুলেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, বিএনপিতে আসলে কী হচ্ছে?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা বলছেন, এক যুগ ধরে দল ক্ষমতার বাইরে। সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে হতাশা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ কারণে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সাময়িকভাবে সব জায়গায় কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবিক কারণে নেতাকর্মীদের আকাঙ্ক্ষাও পূরণ হচ্ছে না। তবে নেতৃত্বের প্রতি কোনও ধরনের অনাস্থা নেই বলে দাবি তাদের। তারা বলেন, বিএনপি এখনও ঐক্যবদ্ধ আছে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটা রাজনৈতিক দলের মধ্যে এগুলো হতেই পারে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে মতামতের ভিন্নতা থাকতে পারে। এটাকে পজেটিভ বলে আমি মনে করি। এটা তো কোনও সামরিক পার্টি না। সুতরাং বিভিন্ন বিষয়ে নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে।’
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেক হতাশা-ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু তারা তা বলার জায়গা পাচ্ছে না। এ কারণে বিভিন্ন আলোচনা সভায় তা প্রকাশ্যে আসছে।’ তিনি মনে করেন, বড় পরিসরে নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি মিটিং করে তাদের কথাগুলো শোনা গেলে এর সমাধান হয়ে যাবে।
গত কয়েকদিনে বিএনপির অনেক নেতার বক্তব্যে দলের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থার আভাস পাওয়া গেছে। গত সোমবার (২৫ মার্চ) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রকৃত গণতন্ত্র চাইলে আগে দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করুন।’
যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘অনেক ব্যর্থ লোক বিএনপির বড় বড় পদে আছেন। তারা বড় গলায় বক্তব্য দেন। কিন্তু আন্দোলনের সময় তিনটা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। দয়া করে যারা ব্যর্থ হয়েছেন, নিজ থেকে দলের পদ থেকে সরে যান।’
এর আগে গত ২৩ মার্চ নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে অনশন কর্মসূচিতে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘যারা হামলা-মামলায় ভয় পায়, তাদের বিএনপির দায়িত্বশীল পদ থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের নেতৃত্বের মধ্যে কোনও সংকট নেই। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি। এরকম মিটিংয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। এই নিয়ে কিছু আসে যায় না।’
গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পরে আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনা সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কোনও কর্মসূচি না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর নেতা ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দলের সিনিয়র নেতারা চেয়ারপারসনের মুক্তির ব্যাপারে কতটুকু আন্তরিক তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা। ২৫ মার্চের আলোচনা সভায় দলটির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করে ’৯০-এ স্বৈরাচারী এরশাদকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছি। তাহলে কেন এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলন করছি না? কর্মীরা আন্দোলন চায়, নেতাদের বলবো, আন্দোলন দেন।’ তার সঙ্গে অন্য নেতাকর্মীরাও একই দাবি তোলেন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠলে দর্শক সারিতে বসা নেতাকর্মীরা প্রশ্ন করেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি নেই কেন? হয় কর্মসূচি দেন, না হয় বিএনপি ভেঙে দেন বলেও মন্তব্য করেন তারা।
এছাড়া গত ২৪ মার্চ এক আলোচনা সভায় ছাত্রদলের ঢাকা কলেজের সহ-সভাপতি এইচ এম রাশেদ মহাসচিব মির্জা ফখরুলের কাছে জানতে চান, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সর্বশেষ যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সেখানে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া হয়নি কেন? তখন মির্জা আলমগীর বলেন, ‘কে বলেছে আপনাকে এই কথা। অবশ্যই মুক্তি চাওয়া হয়েছে। ডোন্ট টেল এ লাই।’
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি না থাকা প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দিবসভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়া অন্য কোনও কর্মসূচি দেওয়ার স্কোপ এখন নেই আমাদের। কারণ, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের কর্মসূচির জন্য যে ধরনের সাংগঠনিক শক্তি থাকা দরকার তা এই মুহূর্তে আমাদের নেই। আর সরকারের আচরণ হচ্ছে—যেভাবে পারো বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলো।’
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘নির্বাচনের পরপর আমাদের তো অবশ্যই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচিতে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারিনি। নেতাকর্মীদেরও সেই একই দাবি। কিন্তু তারা যখন দেখছে তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হচ্ছে না, তখন নেতৃত্বের প্রতি কিছুটা হতাশ হওয়াটাই স্বভাবিক।’
এদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় এখন পর্যন্ত বিএনপির বিভিন্ন জেলার ১৭৩ জন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের এই দুর্যোগের সময় এত নেতাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত কারা নেন, এই প্রশ্ন রয়েছে দলটির মধ্যে।
বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ অভিযোগ করে বলছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘মনোনয়ন বাণিজ্যে’র পর এখন ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ হবে। নির্বাচনের পরে টাকা খেয়ে এদের বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, ‘এভাবে গণহারে তাদের বহিষ্কার করা নিয়ে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। মির্জা ফখরুল একদিন এই নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এই বহিষ্কার নিয়ে পরে বাণিজ্য হবে।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচনে যায় বিএনপি। নির্বাচনের আগে এই জোট নিয়ে বিএনপির মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও নির্বাচনের ফল বিপর্যয়ে তাতে ভাটা পড়ে। এই জোটের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমদ। নির্বাচনের পরে তারা জোটের বৈঠক যান না।
বিএনপি নেতাদের একটি অংশের দাবি, নির্বাচনের সংকটময় মুহূর্তে কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। এ কারণে নির্বাচনে এতো বিপর্যয়। বিএনপি এখন নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
গত ১৪ মার্চ দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দুইজন নেতা ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে সমালোচনাও করেন। ২০ দলীয় জোটের নেতারাও অভিযোগ তুলছেন, তাদের অবহেলা করে বিএনপি এখন ঐক্যফ্রন্টে মনোযোগী হয়েছে।
খালেদা জিয়ার নির্দেশে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল জানিয়ে জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘এখনও তার নির্দেশেই আমরা জোটের ঐক্য ধরে রেখেছি। তবে নির্বাচনের ফলের পর বিএনপির কিছু নেতার মধ্যে জোট নিয়ে কিছুটা অনীহা তৈরি হয়েছে, এটা ঠিক।’

/এইচআই/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ঈদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলবে ১৫ ফেরি, ২০ লঞ্চ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর যেতে সময় লাগবে ৪৪ মিনিট
গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর যেতে সময় লাগবে ৪৪ মিনিট