X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর সই করা কমিটি নিয়ে কৃষক লীগের জালিয়াতি!

মাহবুব হাসান
০৫ অক্টোবর ২০১৯, ২৩:৪৯আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০১৯, ১১:৪৯

কৃষক লীগ

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত চূড়ান্ত কমিটি ভেঙে ইচ্ছেমতো পদ বণ্টনের অভিযোগ উঠেছে দলটির অন্যতম সংগঠন কৃষক লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে।২০১২ সালে এ কমিটি আওয়ামী লীগ সভাপতি অনুমোদন করে দিলেও এর পর থেকেই নিজেদের ইচ্ছায় শেখ হাসিনার কমিটির লোকজন বাদ দিয়ে ও অনেকের নাম ঢুকিয়ে ‘কমিটি বাণিজ্যের’ মাধ্যমে প্রায় নির্বিঘ্নেই মেয়াদ পার করছেন দলটির দুই শীর্ষ প্রধান। এসব সংশোধনীর ক্ষেত্রে কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা এ অভিযোগের কিছুটা স্বীকার করলেও একেবারেই অস্বীকার করেছেন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজা। তবে অনুসন্ধানে অভিযোগগুলোর সত্যতা মিলেছে। এ কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে এসব অভিযোগ সামনে তুলে ধরে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা চাইছেন এসব বিতর্কের যেন অনুসন্ধান করে মূল দল আওয়ামী লীগ আর ভবিষ্যতের কমিটিতে যেন মূল্যায়ন পান সত্যিকারের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা।

প্রসঙ্গত,এ বছরের নভেম্বরের মধ্যেই কৃষক লীগসহ আওয়ামী লীগের চারটি সহযোগী সংগঠনকে সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন দলটির সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের মূল অভিভাবক আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

২০১২ সালের ১৯ জুলাই কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর ১১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি অনুমোদন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কৃষক লীগের অনেক নেতার অভিযোগ, শেখ হাসিনার অনুমোদন করা কমিটিটি কাউকে দেখাননি সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজা। বরং পরে শেখ হাসিনা অনুমোদিত কিছু নাম বাদ দিয়ে বিভিন্ন পদে অন্য লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন তারা। আবার অনুমোদিত কমিটিতে কাটাকুটি করে কাউকে এক পদ থেকে সরিয়ে আরেক পদে বসানো হয়েছে। এদিকে কৃষক লীগ কার্যালয় থেকে এ প্রতিবেদক কমিটির যে কপি সংগ্রহ করেছেন তাতে ১১৬ জনের নাম রয়েছে। সংগঠনের কিছু নেতার অভিযোগ, শেখ হাসিনা অনুমোদিত কমিটি অন্যদের না দেখানোয় যাকে খুশি পদ দিয়ে নেতা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনা অনুমোদিত কমিটিতে আশরাফুল হক জর্জ সদস্য এবং শামসুল হক  দফতর সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু, আওয়ামী লীগ সভাপতি অনুমোদিত কমিটিতে আবারও কাটাছেঁড়া করে আশরাফুল হক জর্জকে  সহ-সভাপতি  এবং শামসুল হককে  সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের প্রমোশন দেন। তবে তাদের এই সিদ্ধান্ত  কার্যনির্বাহী সংসদে অনুমোদন করানো হয়নি। এখনও কৃষক লীগের বিভিন্ন বৈঠকে তাদেরকে যথাক্রমে সহ-সভাপতি ও সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখ হাসিনা অনুমোদিত কমিটির বাইরে আরও অনেককেই কৃষক লীগে বিভিন্ন পদ দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত কমিটিতে নজরুল ইসলাম দুলাল, আবদুল লতিফ তারিন, দেওয়ান মো. জয়নাল, নজরুল ইসলাম মোল্লা, আরিফুল হক দোলন, এটিএম আনিছুর রহমান বুলবুলের  নাম না থাকলেও তারা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি। এদের কাউকে সংগঠনটির কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষে আবার কাউকে অনুমোদন ছাড়াই সহ-সভাপতির পদ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে মূল কমিটিতে নাম না থাকলেও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন নুরে আলম সিদ্দিকী। এছাড়া ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন সাবু আওয়ামী লীগের সভাপতির স্বাক্ষরিত কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন, পরে  তাকে ধর্ম বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে দলটির সবগুলো সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন মূল অভিভাবক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার পরেও তার স্বাক্ষরিত কমিটি কী করে কৃষক লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কাটাছেঁড়া বা অদল-বদল করেন সে প্রশ্ন এখন দলটির বেশিরভাগ নেতা-কর্মীর মুখে। শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত কমিটি কেনই বা দলের বাকি নেতাদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হয়েছিল এবং এর পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে মূল দল আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দলের অনেক নেতা-কর্মী।

জানতে চাইলে কমিটিতে পদের রদবদল আনার অভিযোগ অনেকটা স্বীকার করে নিয়েছেন কৃষক লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমিটিতে থাকা বেশ কয়েকজন নেতা মৃত্যুবরণ করেছেন। সেসব স্থানে নতুন নেতা দেওয়া হয়েছে। আর অনুমোদিত কমিটির বাইরে দু’একটি নাম এদিক-ওদিক হলেও হতে পারে।’

তবে, কমিটিতে পদের রদবদলের বিষয়ে কোনও ধরনের দায় নিতে রাজি হননি সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজা। উল্টো তিনি বলেন, ‘এ রকম অভিযোগ আমিও শুনেছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ তবে, তার স্বাক্ষরে কোনও নাম এদিক-ওদিক হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

কৃষক লীগের শেখ হাসিনা অনুমোদিত কমিটির বাইরে অতিরিক্ত পদ দেওয়ার বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায় গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি সফিকুল ইসলাম ফিরোজ নিজেকে কৃষক লীগ নেতা বলে পরিচয় দিতেন। অথচ গ্রেফতার হওয়ার পর কৃষক লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন বিবৃতি দিয়েছেন, সফিকুল ইসলাম ফিরোজ তার দলের কেউ নন। যদিও কৃষক লীগের সূত্রগুলো বলছে, ফিরোজ কৃষক লীগের নেতা। মাস কয়েক আগে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকেও অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়াও ওপরে উল্লিখিত নামগুলোর মধ্যে থাকা একজন গণমাধ্যমকর্মী কৃষক লীগের সহ-সভাপতি হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পদ প্রাপ্তির চিঠির ছবি দিয়েছিলেন। কিন্তু, অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তার নামও মূল কমিটিতে নেই, তাকে পদ দেওয়ার পরও তা কার্যনির্বাহী সংসদে অনুমোদন করানো হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষক লীগের বেশ কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ করতে না চেয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে অভিযোগ করেন, দু’একজন নয়, অন্তত, শতাধিক পদ দেওয়া হয়েছে কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদন না নিয়েই। কৃষক লীগের বৈঠক বা কোনও সভায় গেলে অনেককে দেখা যায়, যারা সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন পদাধিকারী বলে দাবি করেন কিন্তু কোনোদিন কৃষক লীগ করেননি। যাদের কৃষক লীগের নেতাকর্মীরা চেনেন ও না।তাদের অভিযোগ বিশাল অংকের অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে এসব পদ দেওয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনার অনুমোদিত কমিটি বদল করে পরে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের আনুকূল্যে সহ-সভাপতির পদ পাওয়া নুরুদ্দিন মোল্লা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কৃষক লীগ তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে বলেই তাকে সহ-সভাপতির পদ দিয়েছে। তিনি দাবি করেন, স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে কাজ করে আসছেন। ফলে এ পদ তিনি পেতেই পারেন।

আবার অভিযোগ রয়েছে,শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত কমিটির সহ-সভাপতি এম এ করিমকে কোনও কারণ ছাড়াই বাদ দিয়েছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।যদিও এম এ করিম দলটির দুঃসময়ের কর্মী এ কথা স্বীকার করেন  কমিটিতে থাকা বেশিরভাগ নেতা।

এদিকে বর্তমান কমিটির অধীনে বেশ কয়েকটি জেলায় একাধিকবার কমিটি ভাঙা ও নতুন কমিটি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। ময়মনসিংহ জেলায় তিন বার কমিটি দেওয়া হয়েছে বলে কৃষক লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা অভিযোগ করেন। আর সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় দুই বার কমিটি দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। তবে, কৃষক লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা ও শামসুল হক রেজা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এদিকে নেত্রকোনায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,নেত্রকোনা জেলা কৃষকলীগের সব শেষ কাউন্সিল হয় ২০১১ সালে। এই কাউন্সিলে কেশবরঞ্জন সরকার সভাপতি ও এস এম কামরুল হাসান শাহীন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ২০১৭ সালে এই কমিটি ভেঙে কেশব রঞ্জন সরকারকেই আহ্বায়ক ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি শাহীন উদ্দিন আহমেদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর বছর পার না হতেই আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে ২০১১ সালের কমিটিকেই পুনর্বহালের চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। বর্তমানে এই কমিটির সভাপতি সক্রিয় থাকলেও সম্পাদক দলীয় কোনও কার্যক্রমে আসেন না। ফলে সভাপতির একক নেতৃত্বে চলছে সংগঠনটি।

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা