X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নীতির প্রশ্নে আপসহীনতাই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু করেছে: নূরে আলম সিদ্দিকী

মাহবুব হাসান
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:০০আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:৩৭

নূরে আলম সিদ্দিকী। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ ও দৃঢ়তাই বাঙালির স্বাধীনতা এনে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নূরে আলম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীনতাই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু করেছে। বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে অবিচল থাকায় তিনি হয়েছেন জাতির জনক। তার রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা, নিজস্ব মতামতের ওপর শ্রদ্ধা এবং তা বাস্তবায়নে সংগ্রামই সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে তিনি হয়েছেন বাঙালির অবিসংবাদিত মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক।’ রাজধানীর গুলশানের বাসায় বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত স্বাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন এই রাজনীতিবিদ।’

সত্তরের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী ১৯৭০-১৯৭২ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের চার খলিফার একজন হিসেবে তাকে উল্লেখ করা হয়। মুজিববাহিনীর অন্যতম কর্ণধার ছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘১৯৬৩ সালে আমি ঢাকায় আসি। বাবার আওয়ামী লীগ করার সুবাদে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ। থাকতাম এফ এইচ (ফজলুল হক) হলে। একদিন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেমের বাসায় নিয়ে গেলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, শহীদুল হক মুন্সি ও হাসমত আলী। সেখানে গিয়ে শাহ মোয়াজ্জেমের পাশাপাশি দেখা হয় শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে। বলা যায় সেদিন থেকেই আমার সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ। এরপর বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। পরে সিদ্ধান্ত হলো, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হবো। সেই অনুযায়ী, আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু সে সময় ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি করাটা এক রকম অসম্ভব ছিল। কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সরাসরি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতি এবং শিক্ষা আন্দোলনে জড়িত থাকায় আমাকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হলো। পরে ভর্তি হলাম জগন্নাথ কলেজে। সেখানেও সক্রিয় রাজনীতি করতে থাকি। তারপর ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার এলাম ছাত্রলীগের মূল স্রোতে। কোনও পদ-পদবি না থাকলেও সংগঠনে আমার প্রভাব ছিল ব্যাপক। এই পথ পরিক্রমায় মাঝে মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো। তিনি রাজনৈতিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দিতেন।’ নূরে আলম সিদ্দিকী। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

বঙ্গবন্ধুর দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ হওয়ার পরিক্রমা জানতে চাওয়া হয় নূরে আলম সিদ্দিকীর কাছে। তিনি বলেন, ‘যখন ছয় দফা দেওয়া হলো, অনেকেই তার বিরোধীতা করলেন। দলের বড় নেতারাও তার সঙ্গে ছিলেন না। তারা স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নেই আটকে ছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বাধীকারের প্রশ্ন তুলেছিলেন। ছয় দফা দিয়ে বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে তার স্বাতন্ত্র্যবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন। বড় নেতারা সমর্থন না করলেও ছয় দফা পেশের পর তিনি তা প্রচার করার উদ্যোগ নিলেন। অন্য কয়েকজনের পাশাপাশি আমিও তা মনে-প্রাণে ধারণ করে প্রচার করতে শুরু করি। ৭ জুন হরতাল দেওয়া হলো। মনু মিয়া গুলিতে নিহত হলেন। ৯ জুন আমাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর পাশের রুমেই জায়গা পেলাম। আমাকে দেখেই তার বাবুর্চিকে বেশি করে খাবার রান্না করতে বললেন। এরপর প্রতিদিন কত কথা, কত পরিকল্পনা, ছয় দফা নিয়ে আলোচনা। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে এলাম। কিন্তু এরই মাঝে ছয় দফা পৌঁছে গেলো মানুষের দ্বারে দ্বারে। তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। সে সময় বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে প্রলোভনও দেখানো হলো। তিনি কোনও কিছুর বিনিময়ে ছয় দফা ত্যাগ করেননি; না জেল ছাড়ার প্রস্তাবে, না ক্ষমতার প্রশ্নে। এরপর এলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কেননা পাকিস্তানিরা বুঝে ফেলেন, স্বাধীনতার প্রশ্নে শেখ মুজিবই বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠস্বর থামাতে হবে। তাই এই মামলা হলো। কিন্তু বাঙালি জাতিও ততোদিনে বুঝতে পেরেছে, শেখ মুজিবের হাতেই তাদের মুক্তি। মানুষ তার ডাকে সাড়া দিতে থাকলো। এরপর ৭০ এর নির্বাচনের প্রশ্নে আবার তৈরি হলো মতবিরোধ। অনেকেই স্লোগান দেওয়া শুরু করলো, “ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। উনিই হয়ে উঠলেন একক নেতা। সমসাময়িক অন্যান্য রাজনীতিবিদদের ছাপিয়ে জনগণের চোখের মণি হয়ে উঠলেন। ভোটে জিতে সরকার গঠন করতে না পারলেও পেলেন বঙ্গবন্ধু উপাধী।’

ছাত্রলীগ ভেঙে জাসদ ছাত্রলীগ হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় অবস্থানের কথা আরেকবার উল্লেখ করেন নূরে আলম সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক বলেন, ‘তখন বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার। সে ঢেউ লাগে বাংলাদেশেও। বাম সংগঠনগুলো তো ছিলই, ছাত্রলীগের ভেতরেও একটা অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দাবি তুলতে থাকলো। এই অংশে সিরাজুল আলম খান, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রবরা ছিলেন। কিন্তু, ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলাম। আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, মাজহারুল হক বাকী, কে এম ওবায়দুর রহমান, আব্দুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু দু’পক্ষকেই সমান প্রশ্রয় দিতেন। কিন্তু একদিন টিএসসিতে ওরা বঙ্গবন্ধুকে কমরেড সম্বোধন করে। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোন করে অবস্থান পরিষ্কার করতে বলেন এবং নেতৃত্ব নিতে বলেন। এরপর ৭২ এর সম্মেলনে ওরা এবং আমরা আলাদাভাবে সম্মেলন আয়োজন করলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের ওখানে গেলেন। আর ওরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে আলাদা হয়ে গেলো।’

নূরে আলম সিদ্দিকী ও মাহবুব হাসান (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন) নূরে আলম সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের কথাও তুলে ধরেন বাংলা ট্রিবিউনের সামনে। তিনি বলেন, ‘ছয় দফা দেওয়ার পর তার যেমন বিরোধীতা ছিল, প্রলোভন ছিল, জীবন নাশের আশঙ্কা ছিল। একইভাবে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলাতেও তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে তাকে ফাঁসি দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছিল। এছাড়া কারাগারে তো ছিলেন অসংখ্যবার। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে বঙ্গবন্ধু তবুও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। এই আপসহীনতাই তাকে করেছে বঙ্গবন্ধু, বাঙালির মহানায়ক। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা।’

/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা