X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক চরিত্র হারাচ্ছে বিএনপি!

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২২:৪৩আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০২:৪৭

বিএনপি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করায় বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কারও কারও মতে, এক সময়ের ‘উদার-মধ্যপন্থী’ রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি ধীরে-ধীরে ডানপন্থী অবস্থান বেছে নিচ্ছে। তারা বলছেন, প্রতিক্রিয়াশীল নেতারা দলটিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় মুক্তিযোদ্ধা নেতারা আস্তে-আস্তে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এতে দলটির রাজনৈতিক চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা।
রাজনীতিবিদরা বলছেন, বিএনপিকে এক সময় ‘রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দল’ বলা হলেও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কোনও অবদান ছিল না। কারণ, দলটির তখন জন্মই হয়নি। তবে, সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক যোদ্ধা এ দলটির নেতা। স্বয়ং দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে দলটি ধীরে ধীরে দূরে যাচ্ছে।
বিশেষ করে, ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা রাজনীতির আড়ালে চলে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে বেশিরভাগ নেতা মনে করেন। কারণ রাজনৈতিকভাবে তিনিই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এ অংশের প্রতিনিধিত্ব করতেন। দলীয় ফোরাম ও এর বাইরেও স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক অবস্থানকে সবসময় ‘আপহোল্ড’ করতেন খোকা। কিন্তু ‘সংস্কারপন্থী’ আখ্যা দিয়ে একদিকে তাকে স্থায়ী কমিটির সদস্যপদ দেওয়া হয়নি, অন্যদিকে, সরকার-সমর্থক আখ্যা দিয়ে মহানগরীর আহ্বায়কের পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসার জন্য গত প্রায় দু’বছর ধরে  যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে খোকা আর দেশে ফিরতে পারছেন না। কারণ ইতোমধ্যে একটি মামলায় তারা সাজা হয়ে গেছে। খোকার অনুপস্থিতিতে তার প্রতিপক্ষ বলে বিবেচিত মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলের নিয়ন্ত্রণ পেতে মরিয়া হয়ে উঠছেন।  অনেকের মতে, ইতোমধ্যে অনেকখানি সক্ষমও হয়েছেন তারা।    

সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্য সমর্থন করে গয়েশ্বর আরও কর্তৃত্ব-পরায়ণ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্য সমর্থন করতে গিয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।

এতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থক নেতারা অপমানিত বোধ করছেন। তারা চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অথচ খালেদা জিয়া সমর্থন করছেন গয়েশ্বরকে। কেননা তিনি খালেদা জিয়াকে সমর্থন করছেন। চেয়ারপারসনের সমর্থন নিয়ে স্থায়ী কমিটির ১৬ নম্বর এই সদস্য এখন বিএনপি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর তাকে সমর্থন করছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের  মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ দলের মধ্যে ডানপন্থী বলে পরিচিত কয়েক নেতা। যারা আবার ২০ দলীয় জোটের শরিক  জামায়াতসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোকে উদারপন্থী নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগে কারাগার থেকে কলকাঠি নেড়ে গয়েশ্বরকে মহাসচিব করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাকা চৌধুরী। যদিও শেষ পর্যন্ত এ উদ্যোগ সফল হয়নি। 

অবশ্য, শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অবস্থান থেকে বিএনপি এখনও সরে আসেনি। তার মতে, জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দলের পক্ষে হঠাৎ করে এটি সম্ভবও নয়। এ ধরনের অবস্থান বদল হলে অনেকেই তা সমর্থন করবেন না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের মতে,  মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখা না গেলে সেখানে স্খলন ঘটে। বিএনপিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি ধরে রেখেছে—এ কথা বলা ঠিক হবে না। কারণ, যেসব নেতা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন, তাদের সঠিক জায়গায় পদায়ন করা হয়নি। এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও চেতনা ধরে রাখা যায়নি বলেই অনেক অপশক্তি বিএনপিতে ঢুকে পড়েছে বলে যোগ করেন সাবেক এই সেনা প্রধান।

দলের কেন্দ্রীয় ভাইস-চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, বহুমতের সম্মিলনে গড়া দল বিএনপিতে মাঝে-মধ্যেই মতভেদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা স্বাভাবিক। তবে, দুটি বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। প্রথমত, এটি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল, দ্বিতীয়ত, সরকার বিএনপিকে ডান বা উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। ফলে বিএনপি নেতারা এটি না বুঝলে বিপদ আছেন।

আরেক ভাইস-চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, দলের জাতীয় কাউন্সিলের আগে কিছু বলতে চাই না।

বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধা অন্য নেতাদের মধ্যে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ দলে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর ৩১জন সাবেক এমপি-মন্ত্রীকে নিয়ে বিএনপি থেকে বেরিয়ে যান। অথচ, তার নেতৃত্বে ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ওমর, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদের চেয়ে জুনিয়র এবং অযোগ্য নেতারা দলের স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পেলেও ‘সংস্কারপন্থী’ আখ্যা দিয়ে তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ২০০৯-এর কাউন্সিলের পরে হাফিজকে ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ওমরকে উপদেষ্টা পদ দেওয়া হলেও নীতি-নির্ধারণী কোনও আলোচনায় তাদের ডাকা হয় না। সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান কয়েকবছর আগে মারা গেছেন। কিন্তু জীবদ্দশায় দলে ভালো অবস্থানে ছিলেন না তিনি।

অন্যদিকে, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমেদের মতো  মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নেতারাও দলে আজকাল খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন না।

তাদের বাইরে মুক্তিযোদ্ধা নেতা আবদুল মান্নান ভুঁইয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১০ সালের ২৮ জুলাই মারা যান। অথচ, ১০ বছরের বেশি মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ নেতার মরদেহ পর্যন্ত বিএনপি কার্যালয়ে নিতে দেননি তার প্রতিপক্ষরা। এর আগে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া,  আবদুস সালাম, শাহ মোহম্মদ আবু জাফর, সাদেক আহমেদ খান, মশিউর রহমান, ইশতিয়াক আজিজ উলফাতসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা নেতা টিকে থাকলেও দলে তাদের প্রভাব সামান্য। মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে বিএনপি বিপাকে পড়লে তখন এসব নেতার মাঝে-মধ্যে ডাক পড়ে। যেমন গয়েশ্বর চন্দ্র ও খালেদা জিয়ার বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার এক আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের ডাক পড়ে। খালেদা জিয়ার নির্দেশে আলোচনা সভায় বক্তৃতা দেন তারা।

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান  বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মত ও পথের অনুসারীদের একমঞ্চে এনে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এতে একদিকে সাবেক মুসলিম লীগসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলের নেতাদের তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন, অন্যদিকে চীনপন্থী বাম তথা ন্যাপের নেতাদেরও জায়গা করে দেন। এ সব কারণে মধ্য ও উদারপন্থী দল দাবি করে বিএনপি নেতারা বলতেন, রাজনৈতিকভাবে তাদের অবস্থান ডানের বামে ও বামের ডানে।                    

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদের মতে, মানুষের প্রবৃত্তি বা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারিত বলে ধরা হয়। বর্তমানে যা আছে তা নিয়েই যারা থাকতে চান বা বদল করতে চান না, তারা কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত। আবার যারা বর্তমান অবস্থা বদল করতে চান তারা হলেন প্রগতিবাদী বা বামপন্থী। এই বামপন্থীদের মধ্যে যারা আবার অতি আগ্রহী বা  ‘এক্সট্রিম’ তারা পরিচিত হন অতি প্রগতিবাদী হিসেবে। তিনি বলেন, রক্ষণশীলতাও যাদের পছন্দ নয় বা যারা আরও পেছনে যেতে চান, তারা হলেন প্রতিক্রিয়াশীল।

/এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া