কলম্বিয়ায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা গেল ৭৬ জন। যার অধিকাংশই ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ক্লাব শাপেকোয়েনসের খেলোয়াড় ও স্টাফ। ক্রীড়াঙ্গনে এটাই আকাশপথের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বলা যায়। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ক্রীড়াঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে এর আগেও অনেকবার। ক্রীড়া ইতিহাসে ঘটে যাওয়া তেমন কিছু মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনাকে মনে করে দিল শাপেকোয়েনসে ট্র্যাজেডি :
তুরিনো ফুটবল ক্লাব: সুপারগা বিমান দুর্ঘটনা, ১৯৪৯
১৯৪৯ সালের ৪ মে, পর্তুগালের ক্লাব বেনফিকার বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলে লিসবন থেকে বিমানে করে ফিরছিল পুরো তুরিনো দল। তুরিনের বিমানবন্দরের কাছে সুপারগা পাহাড়ের কালো মেঘের আড়ালে চলে গেল বিমানটি। সামনে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই। নিচে নামতে চেয়েছিলেন পাইলট, কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ব্যাসিলিকা চার্চের একটি উঁচু দেয়ালে ধাক্কা খেল বিমানটি। বিধ্বস্ত হলো বিমান, পুরো ইতালিকে কান্নায় ভাসিয়ে মারা গেলেন পুরো তুরিনো দলসহ ৩১ জন। ১৮ জন ফুটবলারের সঙ্গে দেশ ফেরত বিমানে ছিলেন ক্লাবের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও সাংবাদিক। ইতালির ফুটবলের জন্য ওটা ছিল বিশাল ধাক্কা, কারণ নিহত ১৮ ফুটবলারের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন জাতীয় দলের খেলোয়াড়। ওই মৌসুমে টানা চতুর্থবার সিরি ‘এ’ জয়ের স্বাদ পাওয়া দলটির মর্মান্তিক মৃত্যু হতবাক করে দেয় বিশ্বকে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব: মিউনিখ বিমান দুর্ঘটনা, ১৯৫৮
ইউরোপীয় কাপ কোয়ার্টার ফাইনালে রেড স্টার বেলগ্রেডের সঙ্গে ৩-৩ গোলে ড্র করে সেমিফাইনাল নিশ্চিতের পর দেশে ফিরছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। কিন্তু আর দেশের মাটিতে পা রাখা হয়নি স্যার ম্যাট বাসবির হাতে গড়া ‘ধ্রুপদী’ দলটির। ‘বাসবি বেবস’ খ্যাতি পাওয়া দলের অধিকাংশই মারা যান মিউনিখ বিমান দুর্ঘটনায়। ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে ‘হাই প্রোফাইল’ দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২৩ জন, যার মধ্যে ৮ জন ফুটবলার ছিলেন ম্যানইউর। বেলগ্রেডে ইউরোপীয় ম্যাচ শেষে জ্বালানি নেওয়ার জন্য মিউনিখে থামে বিমানটি। আবহাওয়া ছিল খারাপ, বরফে ঢাকা পড়েছিল বিমানবন্দরের রানওয়ে। দুইবার টেক-অফের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে বিমানবন্দরেই থেকে যায় বিমানটি। কিন্তু বিকাল ৩টা ৪ মিনিটে তৃতীয় প্রচেষ্টা হলো মারাত্মক। টেক-অফের গতি নিয়ন্ত্রণের ভেতর না থাকলেও পাইলট থামেননি, রানওয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে বিস্ফোরিত হয় বিমান। ইউনাইটেড ওইবার ছিল লিগ চ্যাম্পিয়ন, এরপর শীর্ষ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতে লেগেছিল তাদের আরও সাত মৌসুম।
রকি মারসিয়ানো, বক্সার: ৩১ আগস্ট, ১৯৬৯
সাবেক বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন, যিনি তার ৪৯ লড়াইয়ের সবগুলো জিতেছেন। বক্সিং রিংয়ে অপরাজিত এই বক্সার পরাজিত হলেন একটি বিমান দুর্ঘটনার কাছে। ৪৬তম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন ব্যক্তিগত বিমান সেসনা ১৭২ এ চড়ে আইওয়া যাচ্ছিলেন মার্সিয়ানো। কিন্তু বাধ সাধল খারাপ আবহাওয়া। অনভিজ্ঞ পাইলট নিউটনের ছোট একটি মাঠে বিমানকে নামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। রানওয়ে থেকে দুই মাইল দূরে একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ধ্বংস হলো বিমান, মারা গেলেন মারসিয়ানো।
ওল্ড ক্রিস্টিয়ান্স ক্লাব রাগবি ইউনিয়ন টিম: ১৯৭২ আন্দিজ বিমান দুর্ঘটনা
ঘটনাটি বড় শোকের, পাশাপাশি প্রমাণ করেছে মানুষের বাঁচার আকুতি। ১৩ অক্টোবর ১৯৭২, উরুগুয়ে থেকে ওল্ড ক্রিস্টিয়ান্স ক্লাব রাগবি ইউনিয়ন টিমকে নিয়ে ফিরছিল উরুগুয়ান এয়ারফোর্স ৫৭১। চিলির সীমান্তের কাছে আর্জেন্টিনার মেন্দোজার কুয়াশায় ঢেকে থাকা পাহাড়ে ধাক্কা লেগে বিধ্বস্ত হলো বিমানটি। ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বরের আগে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি জীবিতদের। বিমানের ৪৫ যাত্রীর ২৭ জন ওই যাত্রায় বেঁচে গেলেও উদ্ধারকর্মীদের দেখা পাননি। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য পথ খুঁজে গেছেন তারা। ক্লান্ত হয়ে ও তুষারধসে মারা যান আরও ৮ জন। সংগ্রহে থাকা খাবার শেষ হয়ে গেলে বেঁচে থাকতে তারা মৃত সহযাত্রীদের গোশত খেতে বাধ্য হন। ৭২ দিন পর উদ্ধার করা হয় তাদের, যাদের মধ্যে তিনজন সাহায্যের আশায় দুর্গম পাহাড় পাড়ি দিয়ে উঠেছিলেন চূড়ায়।
গ্রাহাম হিল, রেসিং ড্রাইভার: ২৯ নভেম্বর, ১৯৭৫
দুইবারের ফর্মুলা ওয়ান চাম্পিয়ন গ্রাহাম হিল মারা যান ৪৬ বছর বয়সে, না কোনও রেসিং কার দুর্ঘটনায় নয়; বিমানে। উড়তে খুব ভালোবাসতেন, নিজেই পিপার পিএ ২৩-২৫০ টার্বো অ্যাজটেক বিমানের পাইলটের আসনে বসে ছিলেন। ফ্রান্স থেকে ফেরার সময় রাতে ভারি কুয়াশার কারণে বিমান জরুরি অবতরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে জানা গেছে ওই সময় হিলের বিমানের নিবন্ধন ছিল না, তার বিমান চালনার সনদের মেয়াদও শেষ; এমনকি তার পাইলটের লাইসেন্সও।
জাম্বিয়া জাতীয় ফুটবল দল: গ্যাবন বিমান দুর্ঘটনা, ১৯৯৩
সমুদ্রে গ্যাবনিজ ডাইভাররা শুধু জাম্বিয়ান জাতীয় ফুটবল দলের প্রতীক ও খেলোয়াড়দের কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র খুঁজে পান। ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে ঘটে যাওয়া ওই বিমান দুর্ঘটনায় আর কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ২৫ জন খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাসহ ৩০ জনের সলিল সমাধি ঘটেছিল। সেনেগালের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই খেলতে ডাকারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল জাম্বিয়ার জাতীয় ফুটবল দলকে বহনকারী বিমানটি। প্রাথমিক পরীক্ষায় বিমানে ত্রুটি ধরা পড়লেও কানে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। গ্যাবনের রাজধানী লিব্রেভিলেতে ছিল যাত্রাবিরতি, সেখান থেকে উড়াল দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জাম্বিয়ান বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানটির ইঞ্জিনে আগুন লেগে যায়। পাইলট ভুল করে অন্য ইঞ্জিনটি বন্ধ করে দেন, নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায় তখনই। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ওই সময় বেশ উত্থান ঘটেছিল জাম্বিয়ার, কিন্তু বিমান দুর্ঘটনা আবার পিছিয়ে দেয় তাদের। আরও ২০ বছর লেগেছে তাদের প্রথম আফ্রিকান নেশন্স কাপ জিততে।
হ্যান্সি ক্রনিয়ে, ক্রিকেটার: বিমান দুর্ঘটনা ১ জুন, ২০০২ সাল
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক ২০০০ সালের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগের ইতি টানলেন মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০০২ সালের জুনে জোহানেসবার্গ থেকে বিমানে করে নিজ বাড়ি জর্জে ফিরছিলেন হ্যান্সি ক্রনিয়ে। অবশ্য সাবেক প্রোটিয়া অলরাউন্ডারের নির্ধারিত ফ্লাইটটি শুরুতে বাতিল করা হয়। কিন্তু একমাত্র যাত্রী হিসেবে হকার সিডলি এইচএস ৭৮৪ টার্বোপ্রোপ মডেলের বিমানে করে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে কিছু অপর্যাপ্ততায় পাহাড়ের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বিমানটির। দুই পাইলট ও ক্রনিয়ে মারা যান। গুঞ্জন ওঠে জুয়াড়িদের তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কেউ কেউ বলে এখনও বেঁচে আছেন তিনি। সত্য কোনটা বের করা সম্ভব হয়নি এখনও। তবে বিমান দুর্ঘটনায় আরেকটি নক্ষত্রের পতন ঠিকই হয়েছে।
/এফএইচএম/