ভাস্কর ভট্টাচার্যের দু'চোখ কোনওদিন অালো দেখেনি অথচ তিনিই 'অন্ধজনে' অালো বিলিয়ে বেড়ান।
তিনি ছেলেকে পড়ান। বিশেষ সফটওয়্যারের সহযোগিতায় পিসি, ল্যাপটপ, ট্যাব এবং মোবাইলফোন ব্যবহার করেন। নিজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও 'দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বা অন্ধদের' তিনি কম্পিউটার শেখান।
অন্ধদের পড়াশোনার শেখার জন্য তৈরি করেছেন ব্রেইল বই এবং ডেইজি বা টকিং বুক। এই বই নিজে থেকেই পাঠককে পড়ে শোনায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ভাস্কর ভট্টাচার্য ওয়েবসাইটও ডিজাইন করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তিনি সরব। নিয়মিত ই-মেইল ব্যবহার করেন, স্কাইপেতে বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেন। বিদেশে বিভিন্ন সম্মেলনে যোগ দিতে যান একা একা। তার ভাষায়, 'একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যা যা করতে পারে, অামিও তাই পারি।'
তিনি ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করলেও নিজেকে 'একজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ' ভাবতে পছন্দ করেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হিটলার এ. হালিম
বাংলা ট্রিবিউন: প্রযুক্তি অপনার জীবনকে কীভাবে বদলে দিয়েছে?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: যুগে যুগে মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে প্রযুক্তির ইতিহাস মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বের সব প্রতিবন্ধী যদিও একে অপরের থেকে আলাদা এবং একই জাতিও নয়, তবুও উন্নত রাষ্ট্রগুলো সবার জন্য একই বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে সবাইকে মূলস্রোতধারায় অন্তর্ভুক্তির সুযোগ করে দিয়েছে।
এক কথায়, আমার ব্যক্তি জীবনের সীমাবদ্ধতা ২০০২ সালে জাপানের ডাসকিন লিডারশিপ প্রশিক্ষণ (তথ্যপ্রযুক্তিতে ডিপ্লোমা) নানাভাবে প্রভাবিত ও প্রতিফলিত হয়েছে। জাপানের প্রযুক্তি এমনিতেই উন্নত। ক্রমে আমি শ্রম ও মেধার সমন্বয়ে নতুন নতুন আরও প্রযুক্তি ব্যবহারে অনুপ্রাণিত হচ্ছি।
আমি আমার সবধরনের কাজের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। যা আমার জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বলতে গেলে, আমার লাইফ স্টাইল সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। আমি ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছি। সব সময় আমাদের জন্য প্রযোজ্য ও উপযোগী সফটওয়্যারগুলো সার্চ করে ব্যবহার করছি। এজন্য ইপসা-আইআরসিডি (আইসিটি রিসোর্স সেন্টার ফর দ্য ডিজঅ্যাবল্ড) সেন্টার থেকে একদল কর্মীবাহিনীও আমাকে নিরলসভাবে পূর্ণকালীন কাজের মাধ্যমে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
বাংলা ট্রিবিউন: প্রযুক্তির কাছে অাপনার চাওয়া কী?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: আমি একটি বৈষম্যহীন ও সমতাভিত্তিক পৃথিবীতে বাস করতে চাই। যেখানে সবার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুকূল পরিবেশ থাকবে। সব মানুষের সহযোগিতায় আমরা একটি সুন্দর বাসযোগ্য প্রতিবন্ধীবান্ধব বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
প্রযুক্তিগত প্রয়োগের মাধ্যমেই আজ আমার জীবনে অগ্রগতির এক অপার সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। আমি চাই প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবনের সব ক্ষেত্রে যোগাযোগে কোনও বাধা থাকবে না। একুশ শতকের বিশ্বে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সব ধরনের প্রতিবন্ধীর প্রবেশের সুযোগ থাকবে। এজন্য সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যক্রমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। তাহলে আইসিটি সংক্রান্ত কার্যক্রম ও ব্যবহারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আমাদের আরও সাফল্য ও অবদান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পাবে।
বাংলা ট্রিবিউন: অাপনি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। প্রযুক্তি কীভাবে অাপনার চোখের অালো হয়ে উঠল?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: আমার বাসায় ১৯৯৫ সাল থেকে কম্পিউটার ছিল। সেদিন আমি কল্পনা করতে পারিনি যে, আমার দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও কোনওদিন আমি কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারব। নিজের মনের কথা মানুষের কাছে প্রযুক্তির সাহায্যে তুলে ধরতে পারব। প্রযুক্তিই আমার এই অসম্ভব কল্পনাকে, স্বপ্নকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। কোথাও থমকে দাঁড়াতে হয়নি।
একটি ল্যাপটপ ও স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ আমাকে সাবলম্বী হওয়ার পথকে নিশ্চিত করেছে। আজ আমার প্রযুক্তি সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারি, ওয়েবভিত্তিক তথ্য ও প্রযুক্তির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছি।
আসলে ব্যক্তি হিসেবে প্রতিটি মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে। এই অস্তিত্বের মধ্যে মানুষের স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির স্ফূরণ ঘটে। তাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা আমার অভ্যন্তরীণ। এই অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যে দৃষ্টিপাত, আমার সে অস্তিত্ব অনেক জোরালো থাকায় প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহারের মাধ্যমে নয়নের বাঁধ ভেঙ্গে মনের খোলা জানালা আজ আমার চোখের আলো হয়ে উঠল। কবিগুরুর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয় 'অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে।'
বাংলা ট্রিবিউন: প্রযুক্তিতে অাপনার হাতেখড়ির বিশেষ ঘটনাটি জানতে চাই।
ভাস্কর ভট্টাচার্য: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ২০০২ সালে জাপানে ডাসকিন লিডারশিপ প্রশিক্ষণেরর প্রথম দিনে আমার হাতে একটি ল্যাপটপ ধরিয়ে দেওয়া হয়। ট্রেনিং কোর্ডিনেটর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'এটি আজ থেকে তোমার।' বলতে গেলে শুরুতে এভাবেই প্রযুক্তির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল।
এই ল্যাপটপ ব্যবহারের সঙ্গে মিতালি ঘটিয়ে আমার নিজস্ব অবস্থান থেকে ক্রমেই আমি আমার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। যা আমার জীবনকে অবিশ্বাস্য ও অদ্ভূতভাবে পাল্টে দিয়েছে।
আজ আমি আমার কথা একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারছি। এই যন্ত্রটিই আমাকে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করা ও পরিচিত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে যাদের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার বা কথা বলার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। সেই থেকে প্রযুক্তির মাধ্যমে অন্তরের জিনিসকে বাইরে প্রকাশ করার সুযোগ ঘটে যায়। বলা যায়, 'তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই...'
বাংলা ট্রিবিউন: এ বিষয়ে কি অাপনার কোনও পড়াশোনা অাছে?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: আগেই বলেছি জাপান থেকে আমি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছি। পরবর্তীতে প্রতিবন্ধীবান্ধব প্রযুক্তি বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন গবেষণা, উন্নয়ন ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা ও পরামর্শ পেয়েছি।
আমি বাংলাদেশ থেকে DAISY (Digital Accessible Information System) এর ফোকাল পারসন নির্বাচিত হই। এটি সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক Accessible Information System যা পৃথিবীব্যাপী দৃষ্টি প্রতিবন্ধীবান্ধব ই-টেকনোলজি বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
জাতীয় আইসিটি গ্রুপের একজন আহবায়ক হিসেবে আইসিটি সেক্টরকে কীভাবে প্রতিবন্ধীবান্ধব করে গড়ে তোলা যায় এই বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করি।
GAATES (GLOBAL ALLIANCE on ACCESSIBLE TECHNOLOGIES & ENVIRONMENTS) Country Representative হিসেবেও অামি কাজ করছি।
জাতীয়ভাবে এটুঅাই (একসেস টু ইনফরমেশন) কর্মসূচির অধীনে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি।একই সঙ্গে আমি Chittagong Computerized Braille production Centre and ICT & Resource Centre on Disability -এর প্রতিষ্ঠাতা।মাসিক কম্পিউটার জগতে আইসিটি সেক্টর নিয়ে অামি নিয়মিত লেখালেখি করি। এভাবে বিভিন্ন নেটওয়ার্ক ও মিডিয়া সংস্থাগুলোর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকি।
এ ছাড়াও নিজেকে দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে জাপান, থাইল্যান্ড, ভারত, লন্ডন, ফিলিপাইন, চীন, তুরস্কসহ পৃথিবীর প্রায় ২০টিরও বেশি দেশে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতা নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ প্রদান ও গ্রহণ করি।
বাংলা ট্রিবিউন: অাপনি ইপসার (ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন) মতো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প পরিচালক। কীভাবে সম্ভব হলো?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: জাপান থেকে ফিরে এসে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হেয়েছিল। জাপান থেকে দেশে ফিরে এসে আমি সরকারি বেসরকারি কোনও মহলকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছিলাম না যে, প্রশিক্ষণটা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন এমনকি এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যও ভিন্ন।
প্রায় এক বছর আমি বেকার অবস্থায় থাকি। একটা চাকরির জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে থাকি। বিভিন্ন জায়গায় লবিংও করা হচ্ছিল পরিবার থেকে। কিন্তু কোনও মতেই আমার প্রশিক্ষণলদ্ধ মেধাকে উপযুক্ত স্থানে ব্যয় করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না।
২০০৪ সালে বেসরকারি সংস্থার একটি মত বিনিময় সভায় আমার প্রশিক্ষণ সম্পর্কে, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিশ্ব সম্পর্কে আমি আবারও মতামত ব্যক্ত করি। ওই অনুষ্ঠানে ইপসার প্রধান নির্বাহীও ছিলেন। ইপসা একটি প্রতিবন্ধীবান্ধব সংগঠন। তিনি আমাকে ওনার প্রতিষ্ঠানে একটি ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেন।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই যেহেতু একজন লোক নিয়োগ দেওয়ার পেছনে কিছু বিষয়ের চাহিদা রাখে। তিনি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিলেন এবং সুযোগ করে দিলেন প্রযুক্তিবিষয়ক আরও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের, ইন্টারনেট ব্যবহারের অবারিত সুযোগ সুবিধা এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদানের সবরকমের চাহিদাভিত্তিক সুবিধা।
এছাড়া নিজ উদ্যোগে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রজেক্ট তৈরি করানো ও উপস্থাপনার সুযোগও তৈরি করে দেন তিনি। ফলে প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞানে আমি আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠি এবং আমাকে বিশেষভাবে আইসিটি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য 'ডেইজি কনসোর্টিয়াম' এর সহযোগিতায় ইপসা-আইআরসিডি প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করি। ওই প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশিক্ষণার্থীরা ডস ফর উইন্ডোজ, ই-মেইল, মোবাইলফোন ও স্কাইপে সাবলীলভাবে ব্যবহার করতে পারছে।
আমাদের প্রশিক্ষণ সেন্টার থেকে ২৫০ প্রশিক্ষণার্থী বের হয়েছে। ৫০০ -এর বেশি ডিজিটাল টকিং বুক তৈরি করেছি। সম্প্রতি প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বোর্ডের বইগুলো ডিজিটাল টকিং বই করা হয়েছে। জাতীয় ই-তথ্যকোষে পাওয়া যাবে বইগুলো। যা সাধারণ শিক্ষার্থীরাও পড়তে পারবে।
প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে এসে আমার উদ্দেশ্য ছিল দেশের ক্ষীণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তথ্য ও প্রযুক্তি (আইসিটি) ব্যবহারকে সহজ করে একটি সুন্দর জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা। আইআরসিডি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমি সেই সুযোগ পেয়েছি।
বর্তমানে আইআরসিডি প্রকল্পের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছি। এই প্রকল্পে আমরা বিনা খরচে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হলে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, তাকে এখন চাকরি দেওয়া যায়। প্রায়েগিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি, আমাদের এখান থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে অনেকে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে।
বাংলা ট্রিবিউন: প্রযুক্তিকে অাপনি বশ মানালেন কীভাবে?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: মানুষ ছাড়া প্রযুক্তির উদ্ভাবন অকল্পনীয়। আমি যা অর্জন করেছি সেই পথটা সবাইকে দেখিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমার প্রতিষ্ঠানে একটি (আইআরসিডি নামে) সেন্টার প্রতিষ্ঠা করি। আমি প্রশিক্ষক হয়ে সংস্থার উদ্যোগে প্রথমে সেন্টারটি পরিচালনা করি। পরবর্তীতে প্রশিক্ষণার্থীরা বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও পায়। এখান থেকেই মূলত আমার আরও এগিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। সেই বিশ্বাস থেকেই জাতীয়ভাবে প্রযুক্তি বিষয়ে অবদান রাখতে সক্ষম হই। আমার প্রশিক্ষণার্থীরাও অনায়াসে মেইনষ্ট্রিমে কন্ট্রিবিউট করতে পারছে।
বাংলা ট্রিবিউন: 'অন্ধজনে দেহ অালো' এই অাপ্তবাক্যটিকে অাপনি কীভাবে দেখেন?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: ধরুন, সৃষ্টিকর্তা আমাকে এখন জানাল যে, তোমার চোখে আমি আলো দিতে চাই। আমি জবাবে বলব, প্রযুক্তির এই দুনিয়াতে আমি চোখের আলোয় দেখতে চাই না। আমি মনের আলোয় দেখতে চাই। আমার মনের আলো চোখের ভাষা বলবে। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আমি দৃষ্টি চাইব না। আমি মনে করি, আমার আলোহীন চোখদুটি আমার জন্য মোটেই অভিশাপ নয় বরং আশীর্বাদ।
আমার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীত্ব আমাকে এমন অনেক অনন্য সুযোগ, অভিজ্ঞতা অর্জন ও সম্ভাবনা এনে দিয়েছে যা আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী না হলে কখনই সম্ভব হতো না। আমার প্রতিবন্ধীত্ব নিয়ে আমি খুশী ও কৃতজ্ঞ। কেননা এই প্রতিবন্ধীত্বের কারণেই আজ আমি আজকের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি। তাছাড়া আমার পরিবারও সব সময় চেষ্টা করেছে, আমি যেন আমার সক্ষমতার বিষয়ে মনোযোগী হই।
বাংলা ট্রিবিউন: সরকারের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড সম্পর্কে জানতে চাই। অাপনি নিজেই এই ফান্ড থেকে অনুদান পেয়েছেন।
ভাস্কর ভট্টাচার্য: আমি জাতীয়ভাবে ২০১৩ সালে এটুআই প্রকল্পের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঠ্যবইগুলো ই-বুকে রূপান্তর করেছি। যার ফলে সহজেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পড়াশোনা করতে পারছে।
বাংলা ট্রিবিউন: তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন অান্তর্জাতিক সম্মেলনে অাপনাকে অংশ নিতে দেখা যায়। কীভাবে এসব কাজ করেন?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: অগ্রসর প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কীভাবে প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় এই বিষয়ে কাজ করছি। তবে এই প্রক্রিয়াটি এত সহজ ছিল না।
এই বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন নেটওয়ার্কের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছে এবং নেটওয়ার্কের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই। যার জন্য নিয়মিত আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে এই দক্ষতার পরিচয় দিতে গিয়ে এসব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হই এবং অংশ নিই।
মূলতঃ প্রযুক্তির কল্যাণেই আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সামর্থ প্রমাণ ও যোগ্যতার অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে। ইতিমধ্যে আইসিটি কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ দি ইনফরমেশন সোসাইটি উদ্ধাবনী তহবিল (আইএসএফ) এশিয়া, জাতীয় ই-কনটেন্ট অ্যান্ড আইসিটি চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড-২০১০, মন্থন অ্যাওয়ার্ড সাউথ এশিয়া ফর ডেইজিসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছি।
বাংলা ট্রিবিউন: অামাদের জানা অাছে যে, অাপনি নিজেই অাপনার ছেলের স্কুলের পড়া দেখিয়ে দেন, গল্প পড়ে শোনান! যদিও অাপনার ছেলে অাপনার কাছেই পড়তে চাইত। অাপনার মতে, তার ধারণা ছিল, বাবা অামাকে পড়াতে পারবে না। এই অসাধ্য সাধন করলেন কীভাবে?
ভাস্কর ভট্টাচার্য: ধারাবাহিকভাবে কারিগরি প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার সমাজ সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে পারে। আপনারা জানেন, আমরা প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বইগুলো ইলেকট্রনিক হিসেবে তৈরি করেছি।
ডিজিটাল ব্রেইল সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রিন্ট করে পড়া যাবে ব্রেইল সংস্করণ। অডিও শুনেও বইগুলো পড়া যাবে। মাল্টিমিডিয়া সংস্করণ দেখেও পড়া যাবে বইগুলো। এছাড়া বইগুলোর লেখা ইউনিকোডে আছে, যা ননডিজেবল ডেস্কটপ একসেস (এনভিডিএ) সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা।
মূলত আমি আইটি এডুকেশনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত। তাই অডিও, এনভিডি একসেস ইত্যাদি যেকোনও পদ্ধতিতে আমি আমার সন্তানকে পড়াই।
আমাদের লক্ষ্য হলো আইসিটিকে ব্যবহার করে শিক্ষা কর্মসূচিতেও প্রতিবন্ধীদের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসা। যার জন্য আমার না দেখে পড়ানো ও আমার সন্তান দেখে পাঠ গ্রহণ করার মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখছি না।
বাংলা ট্রিবিউন: সময় দেওয়ার জন্য অাপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ভাস্কর ভট্টাচার্য: ধন্যবাদ বাংলা ট্রিবিউনকেও। বাংলা ট্রিবিউন দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাক।
শ্রুতি লিখন: রুশো রহমান
/এইচএএইচ/