X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যে ভয়াবহ ক্ষতির আশঙ্কা

তিন কোটি নষ্ট মোবাইলফোনের কী হবে?

হিটলার এ. হালিম
০৪ মার্চ ২০১৬, ০৭:৪৮আপডেট : ০৪ মার্চ ২০১৬, ০৭:৪৮

নষ্ট মোবাইল ফোনবাংলাদেশে মোবাইলফোনের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। সে হিসেবে পেরিয়ে গেছে ২৩ বছর। এই সময়ে দেশে কয়েক কোটি মোবাইলফোন সেট প্রবেশ করেছে। ব্যবহার যোগ্যতার দিক থেকে শুরুতে যেসব মোবাইল ব্যবহার হতো সেসব মোবাইল এখন আর সচল নেই। হিসাব অনুসারে সেই নষ্ট মোবাইলের সংখ্যা হতে পারে ৩ কোটিরও বেশি।
এই বিশাল সংখ্যক নষ্ট মোবাইল সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে রিসাইক্লিং বা ডাম্পিং করা হয়নি। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কী হবে বা কী হয়েছে সেই ৩ কোটি নষ্ট মোবাইলফোন সেটের? খোঁজ করলে দেখা যাবে, এগুলো ঘরের কোনে, টেবিলে, কম্পিউটারের নষ্ট যন্ত্রাংশের সঙ্গে মিশে রয়েছে বা বাড়ির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
জানা যায়, দেশে দেদারসে মোবাইলফোন সেট এলেও সেগুলো নষ্ট হলে তা ডাম্পিং বা রিসাইক্যাল করার কোনও ব্যবস্থা নেই। ফলে নষ্ট মোবাইলফোন সেট প্রকৃতিতে মিশে যাচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের, ক্ষতি করছে মানবদেহেরও। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে মোবাইলফোন আমদানিকারক হিসেবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শতাধিক। তবে এরমধ্যে ৫২-৬০টি প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে মোবাইলফোন আমদানি করে। অবশিষ্টগুলো অনিয়মিতভাবে কাজটি করে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মোবাইলফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫টি। এসব প্রতিষ্ঠান দেশে মোবাইল আমদানি করলেও নষ্ট মোবাইল কী হবে সে ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
বিএমপিআই-এর সহ-সভাপতি ও সিম্ফনি মোবাইলের জ্যেষ্ঠ পরিচালক রেজওয়ানুল হক জানালেন, ২০১৫ সালে দেশে ২ কোটি ৬০ লাখ মোবাইলফোন সেট আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ হলো স্মার্টফোন। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা হতে পারে ৩ কোটি।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালে ২৫ লাখ, ২০১৪ সালে ৪০ লাখ, ২০১৫ সালে ৬০ লাখ স্মার্টফোন দেশে আমদানি হয়েছে। ২০১৬ সালে তা হতে পারে ৯০ লাখ অর্থাৎ মোট ফোনের ৩০ শতাংশ। আমরা হিসাব করে দেখেছি, প্রতিবছর স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশ। আমাদের ধারণা, দেশে বর্তমানে সক্রিয় মোবাইলফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি (অনেকের একাধিক সিম থাকায় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি)। এর মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ (দেড় কোটির কিছু বেশি) স্মার্টফোন ব্যবহার করে।

ফলে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, এত ফোন যে দেশে আসছে সব তো আর সচল নেই। তাহলে ফোনগুলো সব যাচ্ছে কোথায়? রেজওয়ানুল হক বললেন, দেশে বর্তমানে নষ্ট মোবাইলের সংখ্যা ৩ কোটির বেশি হবে। আগামী ৬ বছর পরে এ সংখ্যা হবে দ্বিগুণ বা ৬ কোটি। সে সময় এই বিপুল সংখ্যক ফোনসেট, ব্যাটারি ডাম্পিং করতে হবে। এখনই উদ্যোগ না নিলে এসব নষ্ট মোবাইলসেট বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনও সিম্ফনির কোনও রি-সাইক্লিং প্রকল্প নেই। তবে আমাদের পরিকল্পনায় বিষয়টি রয়েছে। আমরা পরিকল্পনা করছি কীভাবে নষ্ট মোবাইলফোন, ব্যাটারি রি-সাইক্লিং করা যায়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরেকটি দেশীয় মোবাইল ব্র্যান্ড ওয়ালটনের অপারেটিভ ডিরেক্টর উদয় হাকিম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ওয়ালটন মোবাইল কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই রি-সাইক্লিংয়ের ব্যাপারে সচেষ্ট। এর ধারাবাহিকতায় নিজস্ব ওয়েস্টেজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মাধ্যমে পুরনো মোবাইল ধ্বংস বা রিসাইকেল করা হয়। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে পরিবেশবান্ধব রি-সাইক্লিং সুবিধা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে ১৩ কোটির বেশি মোবাইলফোনের গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল সেটের সংখ্যা ৮ কোটির কিছু বেশি (একাধিক ব্যক্তির রয়েছে ডাবল সিম)। দেশে ই-বর্জ্যের তালিকায় পরিত্যক্ত মোবাইলসেটের ব্যাটারি উল্লেখযোগ্য। পরিত্যক্ত এসব মোবাইলের ব্যাটারি যেখানে সেখানে ফেলার ফলে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইলফোন সেটের বাজারের একটা বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে চীন থেকে আমদানি করা কম দামের মোবাইলফোন সেট। হাজার টাকায় পাওয়া যায় বলে (আরও কমে দামেও পারওয়া যায়) ব্যাপক হারে বিক্রি হচ্ছে মোবাইলফোন। এসবে নিম্নমানের প্রযুক্তি ব্যবহার হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেরামত বা রিসাইকেলের অভাবে শেষপর্যন্ত এগুলোর আশ্রয় হচ্ছে ডাস্টবিনে। নষ্ট ও পরিত্যক্ত মোবাইল ব্যাটারি ফেলা হচ্ছে যত্রতত্র। বিদেশ থেকে মোবাইল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি নীতিমালা থাকলেও মানছে না একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ীরা। কর ফাঁকি দিয়ে চোরাইপথে এসব কমদামি ও নিম্নমানের মোবাইলফোন সেট প্রচুর আসছে। কিছুদিন ব্যবহারের পরে এসব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিণত হচ্ছে ই-বর্জ্যে।

একটি মোবাইলফোন সেটে কী থাকে এবং তা কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে তা জানতে চাইলে সিম্ফনি মোবাইলের হেড অব কোয়ালিটি কন্ট্রোল (বাংলাদেশ) মাজহারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মোবাইলফোনের দুটি অংশ, হ্যান্ডসেট আর ব্যাটারি। হ্যান্ডসেটে থাকে ডিসপ্লে, মেটাল বা প্লাস্টিকের কেসিং, পিসিবি বোর্ড, রিসিভার, স্পিকার, কি-প্যাড ইত্যাদি। এছাড়া থাকে এক্সেসরিজ, চার্জার ইত্যাদি। আর ব্যাটরিতে থাকে ক্যাডমিয়াম, কপার, নিকেল ও জিংক ইত্যাদি।

তিনি জানান, চিপে থাকে আর্সেনিক, গ্যালিয়াম আর্সেনাইট, অ্যান্টিমনি, বেরিয়াম, সিসা, টিন, রাসায়নিক ইত্যাদি। কপারের তৈরি পিসিবি বোর্ডে থাকে প্রটেকটিং কোটিং অ্যাডহেসিভ ইত্যাদি। এছাড়া প্রমিনেন্ট ফ্ল্যাপ রেডিয়েন্টের টক্সিক লেভেল থাকে উচ্চমাত্রার। এলইডি ডিসপ্লেতেও থাকে বিশেষায়িত উপাদান। চার্জারে থাকে কপার ওয়্যার, গোল্ড, ক্যাডমিয়ামসহ আরও অনেক কিছু। প্লাস্টিকের কেসিংও ক্ষতিকর।

তিনি উল্লেখ করেন, প্রমিনেন্ট ফ্ল্যাপ রেডিয়েন্ট –এর কারণে ক্যানসার, চর্মরোগ, শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া, থাইরয়েডের সমস্যা, নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডারসহ অনেক কিছু হয়। অন্যদিকে ক্যাডমিয়ামের কারণে প্রস্টেট ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যানসার, গ্যাস্ট্রিক ও কিডনি সমস্যা হতে পারে। সিসাও অনেক রোগের কারণ। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিও সমস্যা করে বিভিন্ন ধরনের।

মাজহারুল ইসলাম বলেন, প্রয়োজনের মোবাইল সেট প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিকর পদার্থ ও রাসানিকের আকর। ফলে সচেতনভাবে ব্যবহার না করলে নষ্ট মোবাইল আপনার ও পরিবেশের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা করতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, মোবাইলের ব্যাটারিতে আছে লিথিয়াম, যা মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে।

২০০০ সালে আইট্রিপলই ইন্টারন্যাশনাল সিম্পোজিয়াম অন ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিপোর্টে বলা হয়েছে, ব্যাটারি ছাড়া মোবাইলসেটের পিসিবি (প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড) পরিবেশের ৫৯, এলসিডি ৩৯ এবং প্লাস্টিক ও অন্যান্য উপাদান ২ শতাংশ ক্ষতির জন্য দায়ী।

দেশে কোটি কোটি ব্যবহৃত মোবাইলফোন মাটির সঙ্গে মিশে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

/এইচএএইচ/এএইচ/

/আপ-এএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ