X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘উৎসাহ আর ভালোবাসা পেয়েও হেরে যাব?’

মিজানুর রহমান
২৮ মে ২০১৬, ১৭:২২আপডেট : ২৮ মে ২০১৬, ১৮:৩১

মাঈশা মরিয়ম

লক্ষ্যে অবিচল থাকলে কোনও বাধাই এগিয়ে যাওয়ার পথকে রোধ করতে পারে না। মাঈশা মারিয়াম সৈয়দ সেটি প্রমাণ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। শারীরিক কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে বড় হয়েছেন তিনি। তবে সেটি নিয়ে তেমনটা ভাবেন না। প্রচণ্ড অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলেছেন গায়ক, বাদক ও লেখক হিসেবে। হারমোনিকা বাজাতে খুব পছন্দ করেন। নিজেকে হারমোনিকা বাদক হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মাঈশার নিজের মুখে শুনি তার জীবনের কিছু গল্প।

হারমোনিকার শুরুটা কিভাবে?
মাঈশা মারিয়াম: ছোটবেলার থেকেই গানবাজনার সঙ্গে হয়েছি। বাড়িতে গান শোনার এবং গান করার রেওয়াজ আছে, বাবা গিটার বাজান। পাঁচ বছরের জন্মদিনে বাবা একটা খেলনা হার্মোনিকা কিনে দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে খেলাচ্ছলেই সুরের সিকুয়েন্স বানাতাম। খেলতে খেলতে একসময় এমন হয়ে গেল যে, হার্মোনিকার কোথায় কোন স্বর, সবই আমার মুখস্থ হয়ে গেল। তখন কোনও গান বা সুর শুনলে, সেটা নকল করতে পারতাম। তখনও জানতাম না যে, এটা আদৌ একটা বাদ্যযন্ত্র, আর আমি সেটা বাজাচ্ছি। আমার কাছে এটা একটা খেলা ছিল, গান শুনে শুনে গান তোলা। ক্লাস টু তে পড়ার সময় গানের প্রতি আমার আগ্রহ দেখে বাবা একজন গানের শিক্ষক নিয়োগ করেন, তিনি বাসায় এসে শেখাতেন। তার কাছে সা-রে-গা-মা, তাল, ইত্যাদির হাতেখড়ি হওয়ার পর লক্ষ করি আমার ছোট্ট খেলনা হার্মোনিকাটাও আর যেকোনও বাদ্যযন্ত্রের মতোই স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা যন্ত্র। হার্মোনিয়াম বা কিবোর্ডের মতো এতেও সা-রে-গা-মা আছে। তখন স্বরলিপি দেখে দেখে গান তোলা আরও সহজ হয়ে যায়, হার্মোনিকাকেও নতুন করে বুঝতে শুরু করি। স্কুলে ও স্কুলের বাইরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাজাতে শুরু করি। এর মধ্যে বাবা আমাকে একটা প্রফেশনাল হার্মোনিকা কিনে দিয়েছিলেন। পরে যখন ইন্টারনেট আসলো, তখন নেটে হার্মোনিকা নিয়ে আরও জানার সুযোগ পেলাম। বিভিন্ন ব্লগে, আর্টিকেলে হার্মোনিকা সম্পর্কে পড়তে শুরু করি। ইউটিউবে অনেকের ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখেও অনেক কিছু শিখতে থাকি, এখনও শিখছি। জানতে পারি হার্সোনিকার বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে। তারপর এখন খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন ধরনের হার্মোনিকা সংগ্রহ করি আর বাজাই।

শুরুতে কোনও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?

মাঈশা: প্রতিবন্ধকতা পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে একেবারেই ফেইস করতে হয়নি। বাধা পেয়েছি, মানে সমালোচনার শিকার হয়েছি অনেক পরে, সংগীত জগতে প্রবেশ করার পর। আমি গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসি। সেই ঝোঁকটা থেকেই শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গেও আমার হার্মোনিকার বন্ধুত্ব করানোর চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন রাগ রাগিনী হার্মোনিকায় তোলার চেষ্টা করেছি, সফলও হয়েছি। আমার এই এক্সপেরিমেন্টকে আমার আশেপাশের অনেক সংগীতজ্ঞই ভালো চোখে দেখেননি। তাদের কাছে হার্মোনিকা একটা খেলনা, ওতে ক্ল্যাসিকাল বাজানো ধৃষ্টতা। এ রকম বিস্তর সমালোচনা আমার সামনে এবং পেছনে তারা করেছেন। আমি সে সবকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে আরও বেশি করে এক্সপেরিমেন্ট করেছি, এখনও করছি।

মাঈশা মরিয়ম

শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে কখনও অসুবিধা মনে করেছেন?

মাঈশা: আমার শারীরিক কিছু জন্মগত অসংগতি আছে, সেসবের কারণে চলাফেরা করতে কিছুটা অসুবিধা হয় বটে। ছোটবেলা থেকে ডায়বেটিসে ভুগি, সেটার কারণেও প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ি। তবু কখনও হার মানার কথা ভেবেছি বলে মনে পড়ে না। যখনই হতাশ হয়ে পড়ি, কোনও চেষ্টা বিফলে যায়, তখন ভাবি, এর চাইতে বেশি পারিপার্শ্বিক বাধার মধ্যেও অনেক মিউজিশিয়ান প্রতিনিয়ত তাদের কাজ করে যাচ্ছেন। তারা যদি পারেন, সেখানে আমি পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে এত ভালোবাসা আর উৎসাহ পেয়েও হেরে যাব?

নিজের জন্য কী লক্ষ্য ঠিক করেছেন? সে পথে এখন পর্যন্ত কতখানি সফল বলে মনে করেন নিজেকে?

মাঈশা: ২০১৪ থেকে আমি স্বরব্যাঞ্জো নামে একটা ব্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছি। সেই সুবাদে সংগীতাঙ্গনে সম্পৃক্ত অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সামান্য একটু পরিচিতিও পেয়েছি। সাফল্যের গল্প বলতে গেলে বেশকিছু ঘটনাই আমার ঝুলিতে জমা হয়ে গেছে। কেবল নিজে মিউজিক করে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই আমার লক্ষ্য নয়। আমার লক্ষ্যটা আরেকটু বড়।

প্রত্যেক মিউজিশিয়ানের জীবনের লক্ষ্য থাকে যেন সবাই তাকে শোনে To be heard। কিন্তু আমি চাই, সবাই আমাকে শোনার পাশাপাশি আমাকে, আমার যন্ত্রটাকে কিছুটা বুঝুক। যেহেতু আমার বাদ্যযন্ত্রটা বাংলাদেশে খুব বেশি পরিচিত, সমাদৃত নয়, তাই আমি চাই বাংলাদেশের মানুষ, অন্তত যারা সংগীতের সঙ্গে জড়িত তারা হার্মোনিকা যন্ত্রটাকে আরেকটু বুঝুক। এই যন্ত্রটা আমাদের দেশে কেমন যেন কোণঠাসা করে রাখা হয়। সিরিয়াস একটা বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ধরাই হয় না। এই চিত্রটাকে আমি বদলাতে চাই। পাশের দেশ ভারতেই দেখবেন হার্মোনিকা সম্পর্কে প্রচুর গবেষণা হয়, প্রতিটা বড় শহরে এক বা একাধিক হার্মোনিকা ক্লাব রয়েছে। কারা নিয়মিত হার্মোনিকা সম্মেলনের আয়োজন করেন। বহির্বিশ্বেও হার্মোনিকা বেশ সমাদৃত। আমি বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে এই যন্ত্রটাকে একটু গুরুত্ব এনে দিতে চাইছি। যেন পরবর্তী প্রজন্ম হার্মোনিকা বাজায়, তাদের গানে ব্যবহার করে, আর হার্মোনিকাকে এদেশে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য আমাকে স্মরণ করে। এক কথায় আমার লক্ষ্য শুধু শোনানোই নয়। বরং আমি যে ইনস্ট্রুমেন্টটা বাজাই সেটা বোঝানোও।

আপনার অনুপ্রেরণা কারা?

মাঈশা: আমার পরিবার, বন্ধুরা, আমার ব্যান্ড, সবার উৎসাহ আমার জন্য বিরাট অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এর বাইরে আমি সবচেয়ে বড় সমর্থনটা পাই আমার সংগীতগুরু পণ্ডিত অমরেশ রায় চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতে এদেশের একজন বড় পণ্ডিত। সম্প্রতি একুশে পদক পেয়েছেন। তবু আমার এই গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার বাতিকটাকে প্রচুর সমর্থন জোগান। তার মতো জ্যেষ্ঠ,  বিজ্ঞ সংগীতজ্ঞের কিন্তু এ রকম ব্যাপারে এতটা উদার হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তিনি আমাকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে প্রতিটা রাগ রাগিনী নোট বাই নোট হাতে ধরে শিখিয়েছেন এবং হার্সোনিকায় তুলতে সাহায্য করেছেন। তার সমর্থন-সাহায্য না পেলে আমি দেশীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বা ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল বুঝতাম না।

আর জীবনের অনুপ্রেরণা পাই আমার পারিপার্শ্ব থেকে। চারপাশে তাকালে দেখবেন প্রকৃতি ও মানুষ যে যার কাজ ঠিকই করে যাচ্ছে। সূর্যটা প্রতিদিনই উঠছে, কারণ ওটাই তার কাজ। বাতাস বইছে, মেঘ করছে, বৃষ্টি হচ্ছে, ওদের কাজই তাই করা। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে আমাদের সবার অস্তিত্বের একটা করে উদ্দেশ্য আছে। আমরা সবাই বিশাল একটা পাজলের ছোট ছোট অংশ। আপনাকে শুধু খুঁজে নিতে হবে আপনি কোন অংশটা। তারপর সেই স্থান পূরণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। হার্মোনিকা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই হবে হার্মোনিকার প্রতি আমার প্রতিদান।

আপনার লেখালেখি নিয়ে শুনতে চাই...

মাঈশা: লেখালিখিটা আমার কাছে সহজাত। কখনও এটা আমার নিজকে প্রকাশের মাধ্যম, আবার কখনো বা গোপন করার অন্তরাল। যা অনুভব করি, তাই লিখি। সেজন্যই লিখতে ভালো লাগে।

/এফএএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!