X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা ট্রিবিউনে লিখতে ভালো লাগে

ফজলুল বারী
১৯ মে ২০১৬, ১২:৩১আপডেট : ১৯ মে ২০১৬, ১২:৩৪

Fazlul Bariবাংলা ট্রিবিউনের যাত্রা শুরুর আগে অনলাইনটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জুলফিকার রাসেল লেখার জন্যে যোগাযোগ করেছিলেন। জেদের মাথায় তার জবাব দেইনি। জেদটি তার অথবা বাংলা ট্রিবিউনের বিরুদ্ধে নয়। অন্যখানে! এর আগে আমি দেশের আরেকটি অনলাইনে লিখতাম। লিখতে লিখতে এমন গতি চলে এসেছিল যে একদিনে একাধিক লেখাও পাঠিয়েছি! কিন্তু হঠাৎ একদিন তাদের পক্ষে ই-মেইলে জানানো হয়, তারা আমার লেখা আর ছাপবেন না! কারণ জানালো না! ওই সময়ে আমি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান কেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য থাকবে তা নিয়ে লিখেছিলাম। এর কারণে লেখা বন্ধ হলো কিনা তা জানি না।
যাক, ঘটনাটি আমার লেখক স্বত্ত্বাকে অপমান করে! সেখানে লেখার জন্যে আমাকে কোনও সম্মানী অথবা টাকা দেওয়া হতো না। টাকা কখনও আমি চাইওনি। লেখালেখি নিয়ে আমার অনেক সীমাবদ্ধতা। একটা লেখা তৈরি করতে আমার তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে। যতক্ষণ নিজের ভালো না লাগে ততক্ষণ বারবার তা পাল্টাই। বিদেশে আমরা যারা আছি তাদের সময়ের সমস্যা শুধু নিশ্চয়ই অনেকেই জানেন। এখানে এক ঘণ্টা কাজ করলে আমি কুড়ি-পঁচিশ ডলার পাই। নিজের সময় বাঁচিয়ে শরীরের বিরুদ্ধে জুলুম করে আমি লিখি, টাকাও দেয় না আবার ই-মেইল করে জানায় লেখা ছাপবে না, এটি আমার ইগোতে আঘাত করে। সিদ্ধান্ত নেই দেশে আর লিখবোইনা। তাছাড়া আজকাল পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, আপনি যেখানেই লিখুন না কেন তা বেশি পাঠককে পড়াতে সেটির লিংক আবার ফেসবুকে দিতে হয়।
কিন্তু জেদ রাখতে পারলাম কই? আমি যে লেখার পোকা তার আমার ঘনিষ্ঠরা জানেন। বেশি লেখার ব্যাপারে জনকণ্ঠে থাকতে আমার এক ধরনের সুনাম অথবা বদনামও ছিল! জীবনে যখন যেখানে কাজ করেছি, এই একটি অভ্যাস অথবা বদভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে প্রতিদিন বিস্তর লিখতাম। সাংবাদিকতার পেশায় আসার আগে স্কুল জীবন থেকে বিভিন্ন পত্রিকার চিঠিপত্র পাতায় লিখতাম। প্রতি সপ্তাহে চার-পাঁচটা পত্রিকায় চিঠি ছাপা না হলে মন খারাপ থাকতো। পত্রিকার পাতায় চিঠির নিচে ছাপা নিজের নামটি দেখতে যে কী ভালো লাগতো তা বলে বোঝাতে পারবো না। নিজের প্রকাশ যেন এমন পছন্দ করে সব মানুষ!

আরও পড়তে পারেন: নস্টালজিক মানিপ্ল্যান্ট

আমার আবার সাংবাদিকতা পেশায় আসার কথাও ছিল না। আমি পড়তে ভালোবাসি। নিজে নিজে ভাবতাম সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতাও বুঝি আমার নেই। আমি আসলে বিখ্যাত একজন পর্যটক-পরিব্রাজক হতে চেয়েছিলাম। পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষে বিশ্ব ভ্রমণে যাওয়ার স্বপ্ন তখন আমার চোখেমুখে। কিন্তু একজন মিনার মাহমুদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার পর সব ওলটপালট হয়ে গেল। তিনি আমাকে তার সম্পাদিত ‘বিচিন্তা’য় কাজ করতে দিলেন। কাজ মানে আমি সেখানে হয়ে গেলাম দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি! অফিসেই থাকি, খাই, ঘুমাই আর লিখি! এভাবে বিচিন্তার প্রথম সংখ্যাতেই নামে-বেনামে আমার সতেরোটি লেখা ছাপা হয়েছিল। সেই লেখার সঙ্গে নাম ছাপাকে কেন্দ্র করে দেখা দিলো আরেক বিপত্তি। বিচিন্তার সঙ্গে সেখানে আমরা যারা লিখতাম পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জনপ্রিয়তাও পৌঁছে তুঙ্গে! লোকজন এখানে-সেখানে বেশ প্রশংসা খাতিরযত্ন করে। নাম ছাপার এই মোহ লক্ষ্যভ্রষ্ট করে আমাকে। চুলোয় যায় আমার বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন! সাংবাদিকতা হয় আমার নেশা-পেশা সব।

আবার বেশি লেখার প্রসঙ্গে আসি। এই যে বেশি লেখা, এর একটা বিশেষ কারণ আছে। কারণ আমি সব সময় আমার আশেপাশের সাংবাদিকদের চেয়ে কম মেধাবী মনে করতাম। পরিশ্রম দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করতাম সেই সীমাবদ্ধতা। একবার ভারতের নির্বাচন কাভার করতে গিয়ে আমি তিন মাসে দশ লাখের বেশি শব্দ পাঠিয়েছি! আমার আগে যশোরের শামছুর রহমান সে নির্বাচন কাভার করতে যেতেন। আমাকে একজন একদিন বললেন, শামছুর রহমানের লেখায় তথ্য থাকতো বেশি। আর আপনার লেখায় বর্ণনা বেশি। তাকে জবাব দিয়ে বলি, ভাইরে শামছুর রহমান হলেন গিয়ে ভারতীয় পলিটিক্সের পন্ডিতদের একজন। আমার সে পান্ডিত্য নেই বলেইতো বর্ণনা দিয়ে তা ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করি।

এবার দেশে গিয়ে সাংবাদিকদের আড্ডায় আমার বেশি লেখা নিয়ে মজার এক গল্প বলেছেন অগ্রজদের অন্যতম খায়রুল আনোয়ার মুকুল। জনকণ্ঠে আমার সহকর্মী ছিলেন মুকুল ভাই। অফিসে আমি তার সামনের চেয়ারে বসতাম। এখন তিনি কাজ করেন এনটিভিতে। সেই আড্ডায় মুকুল ভাই বললেন- সকালে জনকণ্ঠ অফিসে ঢুকে দেখতাম বারী লিখছে। দুপুরে অফিস থেকে যাওয়ার সময় দেখতাম সে লিখছে! আবার যখন সন্ধ্যায় অফিসে ফিরতাম তখনও দেখতাম লিখছে বারী! রাতে অফিস থেকে যাওয়ার সময়ও তাকে দেখে যাই সে লিখছে!

এ নিয়ে আরেক মজার গল্প যোগ করি আমি। জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খান মাসুদ মাঝে মাঝে মজা করে আমাকে বলতেন, পত্রিকায় আমার (তার) নামতো ছাপা হয় শুধু এক জায়গায়, প্রিন্টার্স লাইনে। আর তোমার নামতো ছাপা হয় পাতায় পাতায়! আসলে আমি জনকণ্ঠের নানা পাতার জন্যে লিখতাম। লিখতাম খবরের কাগজ সহ বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্যেও।

বাংলা ট্রিবিউনে প্রিয় অনেকের লেখা দেখে দেখে আমারও লিখতে ইচ্ছা করে। একদিন প্রিয় আনিস আলমগীর ফেসবুকের ইনবক্সে জানতে চান, আমি এখানে লিখছিনা কেন? তার স্বভাবসুলভ প্রকারে এরপর বলেন, আউলফাউল কতো জায়গায়তো লিখেছেন দেখেছি।

তার কথার ছোট্ট একটা জবাব দেই, লিখবো। এরমাঝে লেখার জন্যে যোগাযোগ করেন বাংলা ট্রিবিউনের অন্যতম একজন উদিসা ইসলাম। এবার চুলোয় যায় আমার দেশে আর না লিখার শপথ! লেখা লিখে উদিসাকে পাঠাই। তা প্রকাশ হলে চারদিক থেকে নানান প্রতিক্রিয়ায় আঁচ করতে পারি এর পাঠকপ্রিয় পরিস্থিতি! আবার শুরু হয় আমার লেখার বাতিক!

আরও পড়তে পারেন: বাংলা ট্রিবিউনে নারীর স্বর শোনা যায়, শোনা হয়

বাংলা ট্রিবিউনে লেখা শুরুর পর ওখানে থাকা আমার প্রিয় এক মানুষ জাকিয়া কংগ্রেচুলেট করলে তাকে মজা করে বলি, টাকা দিবেতো? আনিস আলমগীরতো বলেছে তাকে লেখা পিছু অত হাজার দেয়। জাকিয়া জবাব দিয়ে লিখে, আপনাকেতো বেশি দেওয়া উচিত। এরপর থেকে বাংলা ট্রিবিউনে লিখছি। টাকাও পাচ্ছি। আমি আবার দেশে উপার্জিত টাকা বিদেশে আনি না। দেশে আমার ওপর নির্ভরশীলদের কাছে বিলিয়ে দেই।

বাংলা ট্রিবিউন থেকে লেখার টাকা একবার আমার গ্রামের বাড়িতেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার দেশে গিয়ে বাংলা ট্রিবিউন অফিসে গেলে আমার কাছ থেকে সই নিয়ে দেওয়া হয়েছে লেখার জন্য টাকার একটি খাম। টাকার ব্যাপারে আমি আবার একটু শরমিন্দা টাইপের। তাই স্বাক্ষর করে টাকা নেওয়ার সময় পড়ে দেখিনি তাতে কয়টা লেখার টাকা। কাউকে এ নিয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারি না আমি। এরজন্যে আমি জানিনা লেখা প্রতি তারা আমাকে কত টাকা করে দেয়।

কিছুদিন আগে আবার বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যায় যায় হয়ে গিয়েছিল! সিডনির অলিম্পিক পার্কের বৈশাখী মেলা যেটি হয় তা বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সর্ববৃহৎ বাঙালি সমাবেশ। মেলাওয়ালাদের একটু কাভারেজ দিতে আমার একই লেখা বিভিন্ন জায়গায় দিচ্ছিলাম।

সবাই তা প্রকাশও করছিল। কিন্তু বাংলা ট্রিবিউন থেকে আমাকে জানানো হলো অধ্যাপক  জাফর ইকবাল ছাড়া কারো লেখা তারা এভাবে প্রকাশ করে না। আমার যদি বাংলা ট্রিবিউনে লিখতে ভালো না লাগে তাহলে আমি যাতে তাদের কাছে লেখা আর না পাঠাই। এমনকি তারা অনুরোধ করলও না! জাফর ইকবাল স্যার আমাদের সবার প্রিয় লেখক। তার অনেক পাঠক। কিন্তু আমারওতো অল্পস্বল্প হলেও কিছু পাঠক আছেন! তাদের এই লেখার ভাষাটা গিয়ে আঘাত করে আমার লেখক স্বত্ত্বায়! ঠিক করি আর বাংলা ট্রিবিউনে লিখবোইনা। কিন্তু সে রাগের শপথে অটল থাকতে পারিনি। কারণ আমি যে এখানে লিখতে ভালোবাসি। এটি যে আমার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একদল প্রিয় প্রজন্মের সৃষ্টি। আমি তাদের সঙ্গে থাকতে চাই। তাদের সঙ্গ উপভোগ করি। বাংলা ট্রিবিউনের দ্বিতীয় বর্ষপুর্তিতে সব কর্মী-পাঠকদের শুভেচ্ছা।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
‘এমপি হতে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এটা তুলবো, এটুকু অন্যায় করবো-ই’
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ