X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ওদের শিক্ষা কি পুরা হইয়াছে?’

ফারজানা হুসাইন
০১ জুন ২০১৬, ০৭:১৬আপডেট : ০১ জুন ২০১৬, ১১:৪২

ফারজানা হুসাইন ১.

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল থেকে একটি প্রতিবেদন প্রচার করা হয়েছে দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে। প্রতিবেদনটির ভিডিওটি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, মাধ্যমিকের বৈতরণী পেরোনো মোট ১৩ জন শিক্ষার্থীকে সাধারণ জ্ঞান সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে। এসএসসি বা জিপিএ কী, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কে, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে, বতর্মান রাষ্ট্রপতির নাম কী, পিথাগোরাস কে, নিউটনের সূত্র কী, মাউন্ট এভারেস্ট কোথায় অবস্থিত, অপারেশন সার্চ লাইট কী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস কবে, জাতীয় স্মৃতিসৌধ আর শহীদ মিনার কোথায় অবস্থিত—এ প্রশ্নগুলো বেশ সহজ, স্বাভাবিক আর সময়োপযোগী। কিন্তু যে ছয়জন শিক্ষার্থীকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়েছে তারা কেউই এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারেনি।
সন্দেহাতীতভাবে এ ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তর্ক-বিতর্ক চলছে দেশজুড়ে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমজুড়ে।
এই ভিডিওটি দেখতে দেখতে আমি আমার শৈশব আর কৈশোরে ফিরে গিয়েছিলাম। এক শিক্ষক পরিবারে আমি বড় হয়েছি। পরিবারের প্রায় সবাই শিক্ষকতা করেন বা করতেন, যারা পারিবারিক বন্ধু তারাও প্রায় সবাই শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত ছিলেন। বাড়িতে মেহমান এলে কিছুক্ষণ পর আমার আর আমার ভাইয়ের ডাক পড়ত বসার ঘরে। কোনও রকমে সালাম দিয়ে বসার ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম প্রশ্নবাণের জন্য। কেউ বাংলা ব্যাকরণ জিজ্ঞেস করতেন, তো কেউ ইংরেজি গ্রামার। প্রশ্ন করা হতো, এক মাইলে কত কিলোমিটার কিংবা দেশ রাজধানী মুদ্রাসহ সাম্প্রতিক বিষয়গুলোর ওপর।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম, প্রথম কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি দিতে পারলে, বাহ্‌বার বদলে আমার প্রতি করা পরের প্রশ্নগুলো ধীরে-ধীরে কঠিন হতে থাকত। আর আমি কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে প্রশ্নকর্তার চেহারায় ফুটে উঠত দিগ্বিজয়ের হাসি, এপাশে আমার মাথা আরও ঝুঁকে পড়ত, তা শ্রদ্ধায় নয় বরং অপারগতার লজ্জায়।

যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি সেদিন দিতে পারিনি, কোনও প্রশ্নকর্তা সে উত্তরগুলো সস্নেহে আমাকে শিখিয়ে দেননি কোনওদিন, না পারার জন্য তারা কেবল আমাকে লজ্জাই দিয়েছেন।


অনেক বছর পর সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন দেখলাম বিজ্ঞ সাংবাদিকের এই ভিডিওচিত্রে।

আমি নিজে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, আমি এখানে কোনও শিক্ষার্থীর পক্ষে সাফাই গাইব না। স্কুল পেরোনো এই শিক্ষার্থীদের অবশ্যই দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা দরকার এবং উচিত ছিল। কিন্তু প্রতিবেদনটি দেখার পর আমার প্রশ্ন, এই কিশোর-কিশোরীদের লজ্জা দেওয়া ছাড়া এই প্রতিবেদন থেকে আর কী শিখতে পারলাম আমরা, কতখানি লাভ হলো আমাদের?

ক্যামেরা বন্ধ হওয়ার পর এই ১৩ জনকে আমাদের প্রজ্ঞাবান আর সমাজসচেতন সাংবাদিকেরা কি ভুল উত্তরগুলোর বদলে সঠিক উত্তর শিখিয়ে দিয়েছেন? পৃথিবীর অন্য দেশগুলোয় যখন শুধু স্বাধীনতা দিবস নামে একটি দিন আছে, কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বিজয় দিবস নামে দুটো আলাদা গৌরবময় দিন আছে—এ প্রশ্নের উত্তর কি আমরা ওই লজ্জাবনত ছেলে-মেয়েগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে শিখিয়ে দিয়েছি? বলেছি কি, ‘তোমরা নিজেরা জানো না কতটা মেধাবী তোমরা, একটু চেষ্টা করলে, একটু শিখতে চাইলেই কত কিছু শিখে ফেলতে পারো তোমরা। আজ উত্তরগুলো পারোনি, কিন্তু তাই বলে তোমাদের শেখার দিন শেষ হয়ে যায়নি? না, আমরা বলিনি, আমরা কখনও বলি না।

শেখানোর সময় আমাদের নেই, আমাদের সংস্কৃতি অন্যকে হেয় আর বিব্রত করার। অন্যকে ছোট দেখিয়ে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার অভ্যাস আমাদের মজ্জাগত।

 এ প্রসঙ্গে, বিশ্বখ্যাত শেফ জেমি অলিভারের ক্যাম্পেইন জেমি'স স্কুল ডিনারের কথা বলি। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শরীরের জন্য উপকারী খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার শুরুতে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কিছু শাক-সব্জির নাম। স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী আলুর চিপস আর টমেটো কেচাপকে সব্জি বলায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবাই। গোল্লায় গেল সব—এ হা-পিত্যেসের বদলে ইংল্যান্ডের স্কুলে-স্কুলে শুরু হয় জেমি অলিভারের ক্যাম্পেইন। যেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাতেধরে শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে রান্নায় ও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। ক্যাম্পেইন শেষে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা রান্নায় ছোটখাটো সাহায্য করতে করতেই শিখে গেছে কোনটা সব্জি, কোনটা ফল, কোনটা শরীরের জন্য উপাদেয় নয় মোটেই।

শেখার বা জানার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন। শুধু শিক্ষক, অভিভাবক, গুরুজন হিসেবে তাদের জানতে বা শিখতে উৎসাহ দেওয়া আমাদের কাজ।

২.

প্রতিবেদনে যতটুকু দেখানো হয়েছে তার বাইরের ঘটনা একটুখানি চিন্তা করি? তের-চৌদ্দ বছরের কয়েকটি ছেলেমেয়ের সামনে টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক হাজির হলেন ক্যামেরা হাতে। বলা হলো, কয়েকটা প্রশ্ন করা হবে ওদের, আর এই প্রতিবেদনে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাবে সবাইকে। এত ছোট বয়সে টেলিভিশনে নিজেকে দেখতে কার না ইচ্ছে হয়? নিশ্চয় উত্তেজিত ছেলেমেয়েগুলোর কেউই না বলে দেয়নি সাংবাদিক ভদ্রলোককে। ক্যামেরা অন করে শুরু হলো প্রশ্ন, প্রথম কয়েকটা উত্তর না পারতেই আতঙ্ক গ্রাস করলো বাচ্চাগুলোকে। কি সর্বনাশ! এই প্রতিবেদন যখন টেলিভিশনে দেখাবে তখন পরিবার, শিক্ষক আর বন্ধুদের কাছে মাথা হেট হয়ে যাবে যে! আতঙ্কিত মস্তিষ্ক বাকি প্রশ্নের উত্তরও গুলিয়ে ফেললো, ফলস্বরূপ, প্রতিবেদন শেষে তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের দেশের সবার সামনে মাথামোটা অকাটমূর্খ পরিচয় দিল। এদিকে সাংবাদিক ভদ্রলোক সন্তুষ্ট মনে অফিসে ফিরলেন। এমনকি হতবিহ্বল চেহারাগুলো ঢেকে দেওয়া বা ব্লার করার চেষ্টাও টেলিভিশন চ্যানেলটি করলো না।
সবিনয়ে প্রশ্ন করি, ওই সাংবাদিককে, প্রশ্নগুলো শেষ করে ক্যামেরা বন্ধ করার পর একবার কি জিজ্ঞেস করেছেন, ওই ছেলেমেয়েগুলোকে যে, তারা এখন আদৌ এই প্রতিবেদনের অংশ হতে চায় কি না। আমি নিশ্চিত সাংবাদিক আর জানতে চাননি। তিনি তার মনমতো উত্তরগুলো পেয়ে গেছেন, কী দারুণ একটি নিউজ দাঁড়িয়ে গেছে, কেল্লাফতেহ করে ফেলেছেন যে এতক্ষণে! এই প্রতিবেদন প্রচারিত হলে ছেলেমেয়েগুলো কতখানি ঠাট্টা-বিদ্রূপের শিকার হবে, কতখানি আত্মগ্লানিতে ভুগবে; একবারও ভেবে দেখেননি সেই সাংবাদিক।

এই ঘটনায় আর কী শিক্ষা পেল ওই শিক্ষার্থীরা জানি না, তবে অন্যকে লজ্জায় ফেলে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রমাণ করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার সহজ স্বাভাবিক বিষয়- এই হীন মানসিকতার চর্চা ওদের আজ থেকেই শুরু হলো।
২০০১ সালে গ্রেডিং পদ্ধতিতে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল নির্ধারণ  শুরু হয় যে বিষয়গুলোকে লক্ষ্যমাত্রা ধরে, তার মধ্যে দুটো উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য হলো বাইরের বিশ্বের পয়েন্ট সিস্টেমের সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সমান্তরালিকীকরণ। শিক্ষাথার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞানসহ সব বিষয়ের প্রতি সমান গুরুত্ব দিতে উৎসাহ দেওয়া। শিক্ষার মান যে দিন দিন নিম্নমুখী হচ্ছে, তা বোঝাতে জিপিএ সিস্টেমকে টেলিভিশনের পর্দায় শূলে চড়াতে হয় না। সবার জন্য শিক্ষা—এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পাসের হার বাড়ানোর জন্য বা শতকরা শতভাগ পাস নিশ্চিত করতে শিক্ষাপদ্ধতি, পরীক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীর মান যাচাই কার্যক্রমের পরিবর্তন বা সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, প্রতি বছর জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে দিয়ে মুড়ি-মুড়কির একদর করে আদতে শিক্ষাকেই অশিক্ষায় পর্যবসিত হয়। একই গ্রেড পেয়ে দুজন শিক্ষার্থীর মাঝে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চমৎকার কোনও সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারে, আর অন্যজন যদি কোথাও ভর্তি পরীক্ষায় পাস না করে, তাহলে যে সর্ষেতে ভূত তাড়ানোর পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি, সেই গ্রেডিং পদ্ধতি নামের সর্ষের মাঝেই যে ভূত আসন গেড়ে বসেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, প্রতি বছর লাখ-লাখ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মাঝ থেকে এই ১৩ জন শিক্ষার্থীকে কোন পদ্ধতিতে এই টেলিভিশন প্রতিবেদনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাই। এই ১৩ জন মেধাশূন্য (?) শিক্ষার্থী কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে, কোন অঞ্চল বা বিভাগ, স্কুল থেকে  তাদের শ্রেণিকরণ করা হয়েছে? আমি এ কথা মানতে রাজি নই, এই ছেলেমেয়েরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে তুলে ধরেছে আমাদের সামনে। আমাদের জিপিএ-৫ প্রাপ্ত অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর জানে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে কেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই ১৩ জনকে টেলিভিশনের পর্দায় নেইমিং আর শেইমিং করা হলো? এরা প্রত্যেকেই বয়সে ১৮ বছরের নিচে, অভিভাবকের সম্মতিক্রমে এ ধরনের প্রতিবেদনে ছেলেমেয়েগুলোকে উপস্থাপন করা হতো। শিক্ষাব্যবস্থার ভরাডুবি প্রমাণ করাই যদি এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হতো, তবে আর যাই হোক দেশের সবার সামনে এই ১৩ জনের চেহারা উন্মোচন করে অপমান করা হতো না। শিক্ষামন্ত্রণালয় আর শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অভিমত ও প্রতিবেদনে স্থান করে দেওয়া হতো। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে সম্পর্কে অভিমত থাকত। অভিভাবকদের জিজ্ঞাসা করা হতো তারা কী ভাবছেন।

 

৩.


প্রতিবেদনের আরেকটি দিক বিশেষ লক্ষণীয়। প্রশ্ন-উত্তর পর্বের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এহেন জ্ঞানশূন্যতার পেছনের কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে একজন শিক্ষার্থী,  ৩ জন শিক্ষক ও ১ জন নিয়োগকর্তার কাছে। কিশোরটি অবলীলায় বলে দিয়েছে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সে, বাংলা সমাজ সম্পর্কিত বিষয় সে তেমন পড়ে না। এ কথা শুনে আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম। দেশ গেল, সমাজ গেল এদের হাতে। আমরা গালভরা বুলি আউড়াই শিক্ষার উদ্দেশ্য ভালো গ্রেড বা ফল নয় বরং জ্ঞানার্জন। অথচ, ভালো কলেজে ভর্তির জন্য প্রয়োজন ভালো গ্রেড, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পূর্বশর্ত ভালো গ্রেড, চাকরির দরখাস্ত করার জন্য লাগবে ভালো গ্রেড। তাহলে, কেন আমরা আশা করি শিক্ষার্থী গ্রেড ছেড়ে জ্ঞান অর্জনের দিকে ঝুঁকবে?
প্রতিবেদনে উপস্থিত স্কুলের শিক্ষক বলেছেন, শিক্ষার্থীরা ছোট সিলেবাসে মুখস্ত বিদ্যানির্ভর পড়াশোনা করে পরীক্ষায় পাস করে। স্কুলের চেয়ে কোচিংনির্ভর এই ছেলেমেয়েরা। মেধার অপচয়ের জন্য শিক্ষার্থীর জানার অনিচ্ছা আর কোচিং সেন্টার দায়ী। আমি বিনীতভাবে বলতে চাই, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় বসার জন্য এই ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই কোনও স্কুলের খাতায় নাম লেখায়। স্কুলে নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনের উপস্থিতি ছাড়া তাদের বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয় না। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট দশ বছর যে ছেলেমেয়েরা স্কুলের বেঞ্চিতে বসে, তারা যদি জাতীয় সংগীতের রচয়িতার নাম না বলতে পারে, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস কবে, তা না জেনে পরীক্ষায় পাস করে ফেলে, তবে সেই ব্যর্থতা অবশ্যই শিক্ষকের আর স্কুলের। কোচিং সেন্টার আর ছেলেমেয়েদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমরা পরিবার বা শিক্ষক কেউই পার পেয়ে যেতে পারি না।

এবার আসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রসঙ্গে। প্রতিবেদনটিতে প্রজ্ঞাবান শিক্ষক উল্লেখ করেছেন, মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত অধিকাংশ ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পর্যন্ত পারে না। গত কয়েক বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার নিয়ে খোঁজখবর রাখি, তাই মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের এই তথ্যের প্রতি আমি অকুণ্ঠ সমর্থন দেই। কিন্তু, খটকা লাগে যখন প্রতিবেদনে উপস্থাপিত চাকরিদাতা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী চাকরিপ্রার্থীদের মানযাচাই পরীক্ষায় সেই সাধারণ জ্ঞানের অভাব আর মানহীনতা পরিলক্ষিত হয়। গ্রেড ইনফ্লেশনের মাধ্যমে মেধাহীনেরা জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছে বুঝলাম, তবে শুধু মেধাবীরাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বৈতরণী পার হচ্ছে। যারা ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করছে, তারা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে না। তাহলে এই মেধাবীরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ-ছয় বছরের জীবন শেষে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছেন না? তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার নামে মান যাচাই করে, উচ্চ শিক্ষার নামে শিক্ষার্থীর পাঁচ-ছয় বছরের বিনিময়ে হতাশাই শুধু দিচ্ছি আমরা? সতেরো-আঠারো বছরের শিক্ষাজীবনের শেষে না জানার অপরাধে অপরাধী শুধু ছেলেমেয়েগুলো, না শেখানোর জন্য আর কারও কোনও অপরাধ কি নেই? উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতার অবসান কবে হবে আমাদের?
আমি শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। আমরা তোমাদের পরীক্ষাগারের গিনিপিগ সমান তুল্য করি। শিক্ষার আধুনিকীকরণের নামে রোজ রোজ সিলেবাস বদলাই, সৃজনশীলতার নামে নতুন গাইড বইয়ের বাজারজাত করি, আমরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করি, কিন্তু শেখাই না। তোমাদের মেধাহীনতা আর জ্ঞানশূন্যতার তুমুল আলোচনা করি সবার সামনে, কিন্তু গ্রেড দিয়েই তোমাদের মূল্যায়ন করি। আমাদের শঠতা আর দ্বিমুখিতার অপরাধ তোমরা ক্ষমা করো।

রবি ঠাকুরের তোতা কাহিনী মনে পড়ে গেল—
‘‘নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়া রটাইল, ‘পাখি মরিয়াছে’।...ভাগিনা বলিল, মহারাজ, ‘পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে’।...
রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হু করিল না।
কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা গজগজ্ খসখস করিতে লাগিল।’’


লেখক: আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী।

 

আরও পড়তে পারেন: 'অজ্ঞ শিক্ষার্থী' বনাম 'মূর্খ সাংবাদিক'

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
জাবি ছাত্রলীগের সেই ৩ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ 
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ