X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ময়নাতদন্ত এবং ময়না পাখির গল্প

হারুন উর রশীদ
১৩ জুন ২০১৬, ১৭:৪৬আপডেট : ১৩ জুন ২০১৬, ২২:০৩

হারুন উর রশীদ কয়েকদিন ধরে ময়নাতদন্ত নিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট বেশ শেয়ার হচ্ছে। সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল পোস্টটি দিয়েছেন। ওই পোস্টে তিনি ময়নাতদন্ত শব্দটি কিভাবে এলো তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। লেখার শুরুতেই তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরলাম- কেন পোস্টমর্টেমকে বাংলায় ময়নাতদন্ত বলা হয়?
‘কোনও ব্যক্তির সন্দেহজনক খুন, দুর্ঘটনা বা রহস্যজনক মৃত্যুর সঙ্গে পোস্টমর্টেম কথাটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সাদা চোখে দেখা একটি ঘটনার পেছনে যে আজানা কারণ লুকিয়ে রয়েছে তাকে টেনে বের করতে পোস্টমর্টেমের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু বাংলায় হঠাৎ পোস্টমর্টেমের নাম ময়নাতদন্ত হলো কেন? কেনই বা রহস্য উদঘাটনের মতো এমন একটি বিষয়ের সঙ্গে একটি মিষ্টি পাখির নাম হঠাৎ করে জড়িয়ে গেল?
তার কারণ কি জানেন?
আসলে ময়না পাখির রঙ কুচকুচে কালো। এর পা আর চোখের দু’পাশে থাকে হলুদের ছোঁয়া আর ঠোঁট দুটি কমলা রঙের। কিন্তু মজার বিষয় হলো- ময়না পাখি ১৩ রকমভাবে ডাকতে পারে। অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া তার ডাক সবাই বুঝতে পারে না। তাই যখন রাতের অন্ধকারে এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে তখন শুধু ডাক শুনেই পাখিটি কোথায় আছে তা বোঝা যায়। ঠিক একইভাবে পোস্টমর্টেমও অন্ধকারে থাকা কারণকে সামান্য সূত্র দিয়ে আবিষ্কার করা হয়। আর এই জন্যই পোস্ট মর্টেমকে বলা হয় ময়নাতদন্ত।’
ময়নাপাখি ৩, ১২ না ১৩ ধরনের ডাক ডাকতে পারে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ময়নাতদন্ত নামকরণের কারণ নিয়ে কোনও বিতর্ক যে নেই তা নানা উৎস ঘেঁটে আমি নিশ্চিত হয়েছি। অতলের তল খুঁজে দেওয়াই প্রধানত ময়নাতদন্তের কাজ। আর ইংরেজি পোস্টমর্টেম- এর উদ্দেশ্যও একই। অক্সফোর্ড ডিকশনারি বলছে, ‘Post-mortem: An examination of a dead body to determine the cause of death.’
জুনের ৯ তারিখ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল ময়নাতদন্ত নিয়ে তার ফেসবুকে পোস্টটি দিয়েছেন। হয়তো কৌতুহল নিয়ে অথবা কোনও প্রত্যাশা নিয়ে। তিনিই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু তিনি কি জানতেন এই ময়নাতন্তের অর্থ বদলে যাবে। তিনি কি জানতেন মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বের করার পরিবর্তে ময়নাতদন্ত কারণকে অকারণ বানিয়ে ফেলবে। ধর্ষণকে করে ফেলবে দৈহিক মিলন? হ্যাঁ, বাংলাদেশে তাই ঘটেছে। অন্তত তনুর ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত বিপরীত অর্থ নিয়ে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে।
গত ২০ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু। পরদিন ২১ মার্চ তনুর লাশের প্রথম ময়নাতদন্ত করা হয় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। গত ৪ এপ্রিল ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দেন চিকিৎসক শারমিন সুলতানা। তাতে বলা হয়, তনুকে হত্যার আগে দুর্বৃত্তরা ধর্ষণ করেছে এমন কোনও আলামত ময়নাতদন্তে পাওয়া যায়নি। এমনকি মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কেও তারা নিশ্চিত হতে পারেননি।
এরপর আসে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত। মৃত্যুর ১০ দিন পর তনুর লাশ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাদন্ত করা হয়। আর ১২ জুন দেওয়া দ্বিতীয় দফা রিপোর্টে একই ফল! মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। তবে মৃত্যুর আগে তনুর সঙ্গে ‘যৌন সম্পর্ক’ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৃত্যুর ১০ দিন পর লাশের ময়নাতদন্ত করায় তার শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা, শনাক্ত করা যায়নি। কারণ ততদিনে তার শরীর পচে গেছে। এখন নাকি পুলিশের তদন্তের ওপরই নির্ভর করতে হবে। পুলিশকে দিয়ে এখন অন্ধকারে কালো বিড়াল খোঁজার কাজ করতে হবে।
তবে এর আগে ১৬ মে ডিএনএ প্রতিবেদনে তনুকে ধর্ষণের কথা বলা হয়েছিল। আর দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তে যৌন সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে।
ময়না পাখি সফল!

এ পর্যন্ত যা ফলাফল তাতে তো ময়না পাখিকেই সফল মনে হচ্ছে। তার ১৩ ডাকের কৌশলে সে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছে। কোনও ডাকই বোঝা যায়নি। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা কোনওভাবেই শনাক্ত করতে পারলেন না।
ভারতের প্রখ্যাত পক্ষীবিদ প্রয়াত ড. সলিম আলীর মতে, ময়না পাখির আরও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। তার একটি হলো, ‘এক দলের ময়নার ডাক অন্য দল থেকে ভিন্ন। এমনকি কোনও একদল থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের আরেকটি দলের ডাক ভিন্ন হয়।’
আমি মিষ্টি ময়না পাখিটাকে কোনওভাবে দায়ী করার চেষ্টা করছি না। শুধু তার নিজেকে নানা ডাকের আড়ালে লুকিয়ে রাখার কৌশলটি গ্রহণ করছি। এর এই কৌশলটি কারা নিয়েছেন? অপরাধী, মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ না ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা।
তনু হত্যার পর ময়না তদন্তের আগেই সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা হয়। আর সেখান থেকেই তৎপর হয় ময়না পাখিরা। কেউ কেউ ময়নাতদন্ত এবং সুরতহালকে এক করে ফেলেন। আসলে সুরতহাল হলো ময়নাতদন্তের আগের ধাপ। মরদেহ যেখানে যে অবস্থায় পড়ে আছে। শরীরে বাহ্যিক কোনও আঘাতের চিহ্ন আছে কি না। হাতটি কিভাবে ছিল, চুল কোন অবস্থায় ছিল, পোশাকের অবস্থা- মানে একটি মরদেহের অনুপুঙ্খ বর্ণনা। আর এই সুরতহাল প্রতিবেদন থেকেই অনেক সময় হত্যাকাণ্ডের ধরন বা মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়া যায়। আর ময়নাতদন্তে তা পরিষ্কার হয়। আইন অনুযায়ী সুরতহাল প্রতিবেদন পুলিশ তৈরি করে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে। কিন্তু তনুর সুরতহাল প্রতিবেদন ক্যান্টমেনেন্টের ভেতরে যেখানে লাশ পাওয়া যায় সেখানে করা হয়নি। করা হয়েছে পরে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলকে ক্রাইম সিন হিসাবে সংরক্ষণ করাও তদন্তের অপরিহার্য অংশ। তনুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। উল্টো যেখানে তনুর লাশ পড়েছিল সেখানকার লতাগুল্ম, ঘাস কেটে ফেলা হয়। উপরন্তু সেখানকার মাটি তুলে নিয়ে গর্ত করা হয়। যার প্রতিবাদ তখন জানিয়েছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। অপরাধ বিজ্ঞানীদের কাছে ঘটনাস্থল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা মনে করেন, ঘটনাস্থল এবং আলামত বিশ্লেষণ করলেই অনেক কিছু নিশ্চিত হওয়া যায়। ড. মিজানুর রহমান তাই ঘটনাস্থলের ঘাস কেটে ফেলা এবং মাটি তুলে নেওয়াকে আলামাত নষ্টের অপচেষ্টা বলে অভিযোগ করেন।
মর্নিং শোজ দ্য ডে। তাই শুরু থেকেই বোঝা যচ্ছিল কী হতে যাচ্ছে। পুলিশ তদন্তের জন্য প্রথম দিকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত কারণে ঢুততেই পারেনি। তারপর ঢুকেছে অনুমতি নিয়ে। ঢাকা থেকে আইএসপিআর কিছু সাংবাদিক নিয়ে গিয়েছিল। তাদের বাইরে আর কোনও সাংবাদিককেও ক্যান্টনমেন্টে ঢোকা বা ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া হয়নি। আর একটি মহল বার বার প্রচার করার চেষ্টা করেছে, যে কেউ বাইরে থেকে তনুর লাশ ক্যান্টমেন্টের ভেতরে ফেলেছে উদ্দেশ্য নিয়ে।
তদন্তকারীরা তনু হত্যার দিনে কুমিল্লা ক্যান্টনমেটের নিরাপত্তা এবং গেটগুলোর ডিউটি রোস্টার আজও পেয়েছে কি না আমার জানা নেই। তবে পেয়ে থাকলে অমন সুরক্ষিত একটি এলাকার একটি ঘটনা ময়নাতদন্ত ছাড়াই বের করা যেত।
তারপর প্রথম দফা ময়নাতদন্তের খবর সবাই জানলো। আর প্রশ্ন উঠলো- তনুকে কি তাহলে ভূতে মেরেছে? দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের পর এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তনুকে কি আদৌ হত্যা করা হয়েছে? না সে এমনি এমনিই মরে গেছে। কপাল ভালো তনু হিজাব পরতো। না হলে হয়তো তনুর ‘চরিত্রের নানা দোষ’ বেরিয়ে আসতো দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তে।
সিআইডি এর মধ্যে কিছু লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তার মধ্যে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন সদস্যও আছেন বলে জানা যায়। কিন্তু তনুর মা শেষ পর্যন্ত আসল ঘটনা প্রকাশ করেছেন। কারা তার মেয়েকে হত্যা করতে পারেন তাও জানিয়েছেন নাম ধরে ধরে। কেন হত্যা করতে পারে তাও বলেছেন।
গত ১০ মে তনুর মা আনোয়ারা বেগম প্রকাশ্যেই বলেন, সার্জেন্ট জাহিদ ও সিপাহী জাহিদকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই তনু হত্যাকাণ্ডের সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।
তিনি দাবি করেন, ‘সেনাবাহিনীর স্টাডি ইউনিটের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে তনুকে অনুরোধ করা হয়েছিল। ওইখানে সে গান না গেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সিলেট ভ্রমণে চলে যায়। পরে তারা কুমিল্লা থেকে খোকন ও শান্তা নামে দুই শিল্পীসহ একদল শিল্পীকে টাকার বিনিময়ে এনে অনুষ্ঠানে গান করায়। এ থেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে তনুকে হত্যা করা হয়। এ খুনের সঙ্গে সার্জেন্ট জাহিদ ও তার স্ত্রী এবং সিপাহী জাহিদ জড়িত থাকতে পারে।’ কিন্তু তদন্ত সেদিকে যায় না। কেউ গ্রেফতার হয় না। জিজ্ঞাসাবাদে বার বার ডাকা হয় তনুর মা-বাবা এবং আত্মীয়-স্বজনকে।
এবার দ্বিতীয় দফা ময়না তদন্ত রিপোর্ট শেষ পেরেকটি মেরে দিল। তদন্তকারীরা যেন এর অপেক্ষাতেই  ছিলেন। ময়না পাখিরা এবার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। ময়নাদন্তই যখন ময়নাপাখির ব্যাপারে কোনও তথ্য দিতে পারেনি। তাহলে আর কোন তদন্ত দেবে।
ঘটনাতো এখন উল্টে যাবে। বা উল্টে গেছে। এখন তদন্ত হবে তনুকে অদৌ হত্যা করা হয়েছে কি না। না তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। হত্যা না হলে তো আর হত্যাকারী চিহ্নিত করার দরকার নেই। আর যদি নতুন কোনও তদন্তে দেখা যায়, তনুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাহলে আবার প্রশ্ন উঠবে, তনু ওখানে কাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে মৃত্যুবরণ করেছে। এর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তে ধর্ষণ নয় ‘যৌন সম্পর্ক’ স্থাপনের বিষয়টিতো পওয়াই গেল। মারহাবা ময়নাপাখি- মারহাবা ময়নাতদন্ত!
ময়না পাখির আরেকটি বৈশিষ্ট্য আছে, যা আপনারা সবাই জানেন। সে যে কোনও কথা বা শব্দ অবিকল নকল করতে পারে। তাই আমার মনে এখন প্রশ্ন জাগছে- মামলার তদন্তকারী, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সবাই কি ময়না পাখি। তারা কি কোনও আদেশ নকল করছেন! নয়তো সবাই একসুরে কথা বলবেন কেন? সবার মুখে একই কথা বা গান কেন? তারা কেউই তনুর মৃত্যুর কারণ খুঁজে পান না কেন? পক্ষী বিশেষজ্ঞ ড. সলিম আলী বেঁচে থাকলে হয়তো এর কোনও জবাব দিতে পারতেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৮৭ সালে তিনি মারা গেছেন। ময়না তদন্তের এই ময়না পাখিদের ব্যাপারে তিনি আমাদের আর কোনও সহয়তা করতে পারছেন না।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল:[email protected]

আরও পড়তে পারেন: তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আদালতে

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ