X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

গুলশান হত্যাকাণ্ড: কিছু জিজ্ঞাসা, কিছু উপলব্ধি

রাহমান নাসির উদ্দিন
১১ জুলাই ২০১৬, ১২:১৯আপডেট : ১১ জুলাই ২০১৬, ১৯:০৯

রাহমান নাসির উদ্দিন পহেলা জুলাই গুলশান হলি আর্টিজানের ঘটনা- যেখানে ২০ জন (১৭ জন বিদেশি এবং ৩ জন বাঙালি) জিম্মিকে হত্যা করা হয়, যে ঘটনায় ২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন এবং ৫ জন কথিত জঙ্গি কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়- বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা। এ ঘটনার ভয়াবহতা এবং নৃশংসতা যেমন সবাইকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, তেমনি এ-ঘটনার প্রক্রিয়া, সামাজিক প্রতিক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক মাত্রিকতা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইমেজ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও অনাস্থার-হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য মিডিয়ায় (প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক) যেমন- বিস্তর লেখালেখি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে এবং আলোচনা-সমালোচনা যেমন হয়েছে, তেমনি পাবলিক পরিসরে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে, পারিবারিক আবহের মধ্যেও এ ঘটনার বহুমাত্রিক পোস্টমর্টেম হয়েছে। এ-ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই ঈদের ছুটি থাকায় শহরের মানুষ ঈদ উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতে যায়। ফলে শহুরে নাগরিক বয়ান (ন্যারেটিভ) যেমন গ্রামে চলে যায়, তেমনি গ্রামের মানুষের নিজস্ব ন্যারেটিভ শহুরে ন্যারেটিভকে নতুন উপলব্ধি এবং দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। ফলে কেন্দ্র এবং প্রান্তের বয়ান যৌথভাবে কিংবা পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে ঘটনার নতুন উপলব্ধিতে নতুন মাত্রা দেয়।
এ ঘটনার আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যারা এ-ধরনের ঘটনা ইতোপূর্বে বাংলাদেশে ঘটিয়েছে, তাদের সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষায়, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, পোষাক-আষাক এবং ঘটনা-সংঘটনের প্রক্রিয়ায় এদের সঙ্গে একটা দৃশ্যমান এবং বিবেচনা-যোগ্য ভিন্ন মাত্রার পার্থক্য দেখা যায়। সাধারণত ‘জঙ্গি’ ধারণার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা, বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা, ব্যবস্থাকে সম্পর্কিত করে উপস্থাপনার একটা রীতি বাংলাদেশে চালু আছে। কিন্তু এখানে যারা ঘটনা সংঘটন করেছে তাদের পাঁচজনই ঢাকার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে স্কলাস্টিকা, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম সামনে চলে আসছে। ফলে জঙ্গি, জঙ্গিবাদ, জঙ্গি তৎপরতা প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের অনেকদিনের অনেক ধরনের বোঝাবুঝি নতুন করে সংকটের মুখে পড়ে এবং আমাদের সনাতন-বদ্ধমূল নানান ধারণা গুলশান ঘটনার মধ্য দিয়ে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক উভয়ভাবেই ‘ডিকনস্ট্রাক্ট’ হয়। এরকম একটি জায়গা থেকে গুলশানের ঘটনা নিয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাসা এবং উপলব্ধি এখানে অতি সংক্ষেপে পেশ করছি।
নিরাপত্তার ধারণা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা
২০১৩ সালের রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ‘নিরাপত্তা’র ধারণা নিরাপত্তা বাহিনীর বাইরে পাবলিক পরিসরে একটি জনপ্রিয় এবং প্রয়োজনীয় ‘সাবজেক্ট’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। যদিও রমনা বটমূলের হামলা, নারায়ণগঞ্জের সিনেমা হলে হামলা, উদীচীর সম্মেলনে হামলা, আওয়ামী লীগের জনসভায় হামলা প্রভৃতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেও ‘মৌসুমী উত্তেজনা’ হিসাবে পরবর্তীতে পাতলা হয়ে যায়; ফলে জনপরিসরেতা আর দীর্ঘমেয়াদে স্থায়িত্ব পায়নি। কিন্তু গত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান জঙ্গি তৎপরতা এবং প্রায় ৪০ জনের মতো ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, গবেষক, প্রকাশক, পীর, ভান্তে, পুরোহিতকে একের-পর-এক একই কায়দায় হত্যা করার সূত্র ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক নিরাপত্তা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার বিষয়টি পাবলিক পরিসরে আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। তাই গুলশানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে সামনে চলে আসে। গুলশানের মতো একটি সংবেদনশীন কূটনৈতিক এলকায় (সেনসিটিভ ডিপ্লোমেটিক জোনে) এতো নিরাপত্তা চৌকি পার হয়ে এতো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এতোগুলো যুবক মাইক্রোবাসে করে হলি আর্টিজান বেকারিতে প্রবেশ করলো, অথচ কোথাও কেউ এতোটুকু আঁচ করতে পারলেন না কেন? যে রেস্তোরাঁয় নিয়মিতভাবে বিদেশিরা যাতায়াত করে, যেখানে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার বিদেশি অফিশিয়াল কাস্টমার হিসাবে যাতায়াত করে, সেখানে বাংলাদেশে কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার কোনও লেভেলে কোনও ধরনের নজরদারি ছিল না কেন? বিশেষ করে, যখন দেশে বিদেশিদের হত্যা করার একটা প্রবণতা দীর্ঘদিন থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে কিছুদিন আগে একজন ইতালিয়কে হত্যা করা করা হয়, একজন জাপানিকে হত্যা করা হয়, সেখানে এতো বিদেশির নিয়মিত যাতায়াত থাকার পরও গোয়েন্দা সংস্থার কোনও নজরদারি ছিলো না কেন? হয়তো কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, ঢাকা শহরে অসংখ্য রেস্তোরাঁ আছে এবং এর অনেকগুলো রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা নিয়মিত যাতায়াত করেন, গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে সব রেস্তোরাঁয় নজরদারি করা সম্ভব নয়। যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই যে, এটা ব্যবহারিক অর্থেই অসম্ভব। কিন্তু কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তা এবং বিদেশিদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাহলে কেন এত বড় একটা ঘটনার এত বড় একটা পরিকল্পনার কথা গোয়েন্দা সংস্থার কেউ কোনোকিছুই আঁচ করতে পারলেন না? এ প্রশ্ন বারবার আমার মাথায় হানা দিচ্ছে। এর সঠিক উত্তর জানা জরুরি। যদি এটাকে গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসাবে ধরে নিই, তাহলে বাংলাদেশকে অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। জনগণের টাকায় বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে চালানো হয়। তাই জনগণের অধিকার আছে কেন এত বড় একটা ঘটনার পরিকল্পনার আগে কিংবা ঘটনা সংঘটনের আগে কোনও কিছুই এদেশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন জানতে পারলেন না। অনেকের মনের মধ্যে এ প্রশ্ন আছে কিন্তু ভয়ে এবং শঙ্কায় অনেকে এ প্রশ্ন তুলতে পারছেন না। কিন্তু দেশের এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে এদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যতটুকু গোপনীয়তা প্রয়োজন, ততটুকু বিবেচনায় রেখে কেন এরকম একটি ঘটনার কোন প্রাক-তথ্য আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার ছিল না, সেটা জনগণের কাছে পরিষ্কার করা হোক। 

মিডিয়ার দায়িত্ব এবং পাবলিক ডিজাইয়ার!

গুলশানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নানা পর্যায়ে বেশ সমালোচনা করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মিডিয়া’কে মোটামুটি সোনা-রূপার পানি দিয়ে ধুঁয়ে দেয়া হয়েছে। খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ার অপেশাদারি ভূমিকার জন্য মিডিয়াকে ‘আচ্ছা করে বকে দিয়েছেন’। আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও মিডিয়াকে মোটামুটি মৃদু-কায়দায় শাসানো হয়েছে। মিডিয়ার লোকেরাও মিডিয়ার অপেশাদারি ভূমিকার জন্য আত্মসমালোচনা করেছেন এবং কোনও কোনও মিডিয়া নিজেদের ভুলও স্বীকার করেছেন। মিডিয়া যে কাজটা করছিল সেটা হচ্ছে, রীতিমত পাগলা প্রতিযোগিতা করে গুলশানের জিম্মি ঘটানার ‘লাইভ’ সম্প্রচার করছিল। মিডিয়ার এ বেপরোয়া বাড়াবাড়ি দেখে র‌্যাবের প্রধান মিডিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে ঘটনার আপডেট সরাসারি সম্প্রচার না-করেন। আমি মনে করি জিম্মিদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে এবং জিমি উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিকল্পনার গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে র‌্যাবের পরিচালকের এ-অনুরোধ সময়োচিত ও যথার্থ ছিল। এবং র‌্যাবের পরিচালকের অনুরোধের পরে বেশ কয়েকটা টিভি চ্যানেল সত্যিকার অর্থেই সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ রেখেছিল। একথা সত্য যে এধরনের ঘটনা কাভার করার ক্ষেত্রে আমাদের মিডিয়ার কোনও প্রাক-অভিজ্ঞতা নাই। রানা প্লাজার ধসের লাইভ আর সন্ত্রাসী কতৃক জিম্মি মানুষকের উদ্ধারের লাইভ যে এক জিনিস নয়, সেটা বোঝার সাবালকত্ব আমাদের অনেক মিডিয়ার বিশেষ করে ‘লাইভ-ফোবিয়া’য় আক্রান্ত অনেক ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া অর্জন করেনি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে কেবল মিডিয়াকেই একতরফা এবং পাইকারী হারে দোষ দিতে নারাজ। কারণ ‘পাবলিক ডিজাইয়া’র বলে একটা বিষয় আছে যার খোরাক জোগানোর দায়িত্ব মিডিয়ার। যেমন আমি নিজের ব্যক্তিগতভাবে প্রতি মিনিটে কী আপডেট আছে এবং কোন চ্যানেল কোন আপডেট দিচ্ছে সেটা জানার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম। আমি নিশ্চিত আমার মতো বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ, যারা মিডিয়ার সংবাদের ভোক্তা, ঘটনার আপডেট জানার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন। তাই মিডিয়ার এটাও দায়িত্ব যে, মানুষের চাহিদার প্রতি সুবিচার করা। তাই লাইভ টেলিকাস্ট করার ক্ষেত্রে মিডিয়ার পেশাদারিত্বের অভাবের পাশাপাশি পাবলিক ডিজাইয়ার মিটানোর ক্ষেত্রে মিডিয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টাকেও আমি পাশাপাশি রেখে মিডিয়াকে বিচার করতে আরাম বোধ করছি। তবে গুলশানের ঘটনাকে একটা এক্সপেরিমেন্টের কেস হিসাবে নিয়ে এ-ধরনের ঘটনার কাভার করার ক্ষেত্রে মিডিয়া কতোটা সাবালক হলো, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 জঙ্গিবাদ, ইসলামাইজেশানএবং কোলেটারাল ডেমেজ

‘বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি’-একথা মোটামুটি এখন বাংলা প্রবাদে পরিণত হয়েছে! ২০০১-২০০৬ সালের বিএনপি জামায়াত সরকারের আমলে এ উক্তির জন্ম যা ‘জঙ্গিবাদ’ সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা কিংবা রাষ্ট্রীয় অস্বীকৃতির (স্টেট ডিনায়েল) স্মারক হয়ে আছে। তারও আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে ‘আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস’ এবং জেনারেল এরশাদের আমলে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজের এবং রাষ্ট্রের চরিত্রের যে ইসলামাইজেশান হয়েছে, তারই প্রতিফল ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশের একটি গ্রামে আমি ‘ধর্মীয় চরমপন্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ডাইয়ালেক্টিক্স’ নিয়ে গবেষণার কাজ করছি। সেখানে বারবার যে বিষয়টি উঠে এসেছে সেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রের চরিত্রকে একটি ধর্মীয় অবয়ব দিয়ে আমরা যদি সমাজকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে বলি, সেটা কাউন্টার-প্রোডাকটিভ হতে বাধ্য। আজকের ধর্মীয় উগ্রপন্থা যাকে আমরা জঙ্গিবাদ বলছি এটা তারই নগদফল। ফলে জিয়া এবং এরশাদের আসকারায় রাষ্ট্রের ইসলামাইজেশানের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা আরও সংহত হয়েছে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনি অ্যালায়েন্সের নামে রাজনৈতিক মহাব্বত। ১৯৯১ এবং ২০০১ সালের বিএনপির সঙ্গে আর ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত নির্বাচনি সমঝোতার নামে রাজনৈতিক গাঁট বাঁধে যার হাত ধরে ধর্মীয় রাজনীতি এদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা ধর্মীয় উগ্রপন্থা যে কতোটা ভয়ংকর হতে পারে, সেটা ইতোমধ্যে এদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। এটাকে বলে, ‘কোলেটারাল ডেমেজ’। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে ২০১৩ সালে শাহবাগে যে জনজোয়ারের সৃষ্টি হয়, তারই পাল্টা ফোর্স হিসাবে হেফাজতসহ বেশ কিছু ইসলামপন্থী সংগঠন শাহবাগ আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন হিসাবে উপস্থাপন করে ‘ব্লগার’ হত্যায় নামে। দেশে তখন ‘জঙ্গিবাদ’ ক্রমান্বয়ে একটি চরম আকার ধারণ করে। একে একে অসংখ্য ব্লগারকে হত্যা করা হলো, শিয়াদের মিছিলে হামলা করা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খুন করা হলো, মুক্তমনা লেখকদের একে একে খুন করা শুরু হলো। বাদ গেলো না মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার পাদ্রি, মঠের ঠাকুর, ভান্তে, কিংবা উদারপন্থী ইসলামিক চিন্তাবিদ।

এভাবে জঙ্গিবাদ বলতে বাংলাদেশে যা বোঝায় তা চরম আকার ধারণ করে। তবে এতোদিন সেটা রূপ ছিল কিছু চোরাগোপ্তা হামলা, অতির্কিত হামলা কিংবা গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা। কিন্তু গুলশানের ঘটনা বাংলাদেশের বিদ্যমান এবং বিরাজমান জঙ্গিবাদের একেবারেই একটি ভিন্ন রূপ হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়। এটাকে বলা হচ্ছে ক্রমবিস্তারমান জঙ্গিবাদের দ্বিতীয় পর্যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এধরনের অসংখ্য ঘটনার নজির থাকলেও বাংলাদেশে এধরনের ঘটনার এটাই প্রথম। তাই এ ঘটনা সবাইকে একটা বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। আর যারা এধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের পরিচয় এবং পারিবারিক-ব্যাকগ্রাউন্ড ঘটনার মাত্রা, ধরন এবং এর সামাজিক প্রভাব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আতঙ্ক তৈরি করেছে। তাই জঙ্গিবাদের প্রথম পর্যায়ে জঙ্গিবাদ দমনে সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে পলিসি, যে কৌশল এবং প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছিল, তারও আমূল পরিবর্তন জরুরি হয়ে উঠেছে। আমরা আশা করছি- সাধারণ মানুষের মতো সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীও বিষয়গুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে, সময়োপযোগী চিন্তা এবং পরিকল্পনা নিয়ে নিজেদেরকে তৈরি করবেন।

বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে বিভিন্ন সংখ্যাতাত্ত্বিক সূচকের হিসাব-নিকাশ ধরে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করছে এবং উন্নয়নের মডেল হিসাবে বিশ্ব অর্থনীতির ক্যানভাসে বাংলাদেশের নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে সে উন্নয়ন নানান অবকাঠামোর নিত্য বেড়ে ওঠার ভেতর দিয়ে বেশ দৃশ্যমানও হচ্ছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে, সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করতে না পারলে এবং মানুষকে যদি নিত্য একটা ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করতে হয়, তাহলে সকল উন্নয়ন শেষ বিচারে অনুন্নয়নের সূচকে পরিণত হবে। তাই সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় আম-ছালা দু’টোই যাবে। দুধের ভাত জঙ্গি খাবে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ