X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শুধু বডি ল্যাঙ্গুয়েজই কি যথেষ্ট?

হারুন উর রশীদ
০৭ আগস্ট ২০১৬, ১৮:৩৪আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৬, ২১:০৮

হারুন উর রশীদ মুখের হাসি দেখেই আমরা বলে দিতে পারি না লোকটি সুখী। আবার গোমরা মুখ দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে, কেউ অসুখী। ওটা ছবির ভাষা হতে পারে। আমরা বড়জোর বলতে পারি ছবিতে তার হাসিমুখ। অথবা গোমরা মুখের ছবি। ছবির ভাষা প্রকৃত ভাষা বা পরিস্থিতিকেও সব সময় ব্যাখ্যা নাও করতে পারে। কখনও কখনও হয়তো করে।
গুলশান হামলার পর গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হাসনাত করিম এবং কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খান আলোচনায়। তারা হামলার পরদিন সকালে অভিযানের আগে জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পান। এরপর তারা বারবার পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়ে এখন ৫৪ ধারায় আটক হয়ে গুলশান হামলার ঘটনায় আট দিনের রিমান্ডে আছেন। চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। সেই জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে পরে আসছি তার আগে আরও কিছু ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে নেই।
গুলশানে হলি আর্টিজানে অভিযান হয় ২ জুলাই সকালে। সেই অভিযানের আগে এবং অভিযানের সময়ের কিছু ভিডিও ফুটেজ ধারণ করেন এক কোরিয়ান নাগরিক। তিনি তার ফেসবুকে পোস্ট করলে ২ জুলাই রাতেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। পরে তিনি তার ফেসবুক থেকে ফুটেজের পাঁচটি ক্লিপ সরিয়ে ফেললেও এরইমধ্যে অনেকের হাতে পৌঁছে যায় সেই ফুটেজ। আর সেখান থেকেই হাসনাত-তাহমিদকে নিয়ে বিতর্কের শুরু। তারা দু’জনই অভিযান শুরুর আগে সকালে মুক্তি পান। কোরিয়ান নাগরিকের ভিডিওতে তারা যে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তা স্পষ্ট। এরমধ্যে হাসনাত করিম বের হন সপরিবারে।
ওই ভিডিও ফুটেজে হাসনাত করিমকে সকালে আর্টিজানের ভেতরে জঙ্গিদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আলোচনা করতে বা কিছুটা হাঁটতেও দেখা যায়।
৩ জুলাই সংবাদ মাধ্যমে একটি ছবি ছাপা হয়। তাতে দেখা যায় আর্টিজানের দোতলার বারান্দায় সামনে হাসনাত করিম এবং পেছনে এক জঙ্গি ও তাহমিদ। ছবি দেখে মনে হয় তারা হাঁটছেন।
আরেকটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। ছবিটি হাসনাত ও তাহমিদ মুক্তি পাওয়ার পর। মুক্তি পাওয়ার পর পুলিশ তাদের প্রথমে একটি বাড়িতে রাখে। সেখানে হাসনাত-তাহমিদ মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। হাসনাতের পরিবারের সদস্যরাও সেখানে ছিলেন।

এ পর্যন্ত যে ছবি এবং ভিডিও ফুটেজের কথা বলা হলো তাতে যে প্রশ্ন উঠেছে তা হলো:

১. হাসনাত ও তাহমিদ এতটা স্বাভাবিক ছিলেন কিভাবে?

২. জঙ্গিরা হাসনাতের সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলেছে?

৩. তাদের এই স্বাভাবিক মুভমেন্টের কারণ কী?

৪. জঙ্গিদের সঙ্গে হাসনাত ও তাহমিদের সম্পর্ক কী?

৪. হাসনাত ও তাহমিদের সম্পর্ক কী?

রবিবার সংবাদ মাধ্যমে আরও দু’টি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। একটিতে আর্টিজানের ছাদে এক জঙ্গির সঙ্গে হাসনাত এবং তাহমিদকে দাঁড়িয়ে আলাপ করতে দেখা যায়। একই স্থানের ভিন্ন ফ্রেমের আরেকটি ছবিতে তাহমিদের হাতে একটি আগ্নেয়াস্ত্র (স্মল আর্মস) দেখা যায়। আর জঙ্গির বুকে বেল্টে বাধা ভারী আগ্নেয়াস্ত্র।

Hasnat-2 তবে এই সব ছবি এবং ভিডিও ফুটেজে যা দেখা গেছে তার বাইরে আরও অনেক তথ্য আছে যা আমরা এখন পর্যন্ত জানি না। সেই তথ্য জানা গেলে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেত। আমি এখানে এই ছবি ও ভিডিও ফুটেজের গ্যাপগুলো উল্লেখ করতে চাই।
১. কোরিয়ান নাগরিকের ভিডিও ফুটেজে শব্দ স্পষ্ট নয়। ফলে বোঝা যাচ্ছে না হাসনাত আর্টিজানের ভেতরে জঙ্গিদের সঙ্গে কী কথা বলছিলেন।
২. স্টিল ছবির আগের ও পরের  প্রয়োজনীয় সিকোয়েন্স নেই।
৩. তাই এই ছবিগুলো দিয়ে বোঝা সম্ভব নয় যে হাসনাত ও তাহমিদ কোন পরিস্থিতিতে জঙ্গির সঙ্গে আর্টিজানের দোতলার বারান্দায় হেঁটেছে এবং ছাদে গিয়ে কথা বলেছে।
৪. ছবিতে তাহমিদের হাতে যে অস্ত্র দেখা গেছে তা কী শুরু থেকেই তার হাতে ছিল? এই একটি ছবি দেখে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।
৫. অস্ত্র কী সে স্বেচ্ছায় হাতে নিয়েছে তা ছবি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
বৃহস্পতিবার হাসনাত ও তাহমিদকে রিমান্ডে চেয়ে আদালতে যে আবেদন করা হয় তাতে বলা হয়েছে, হাসনাত করিম নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের সদস্য আর তাহমিদ তার সহযোগী। বলা হয়েছে হাসনাত করিম আর্টিজান হামলার জঙ্গিদের উৎসাহ দাতা। আর তার মোবাইল ফোন থেকে জঙ্গিদের বিশেষ অ্যাপস ডাউনলোড করা হয়।

এরইমধ্যে গুলশান হামলায় যারা বেঁচে গেছেন তাদের ছয়জন আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। মোট বক্তব্য নেওয়া হয়েছে ৪০ জনের। কোরিয়ান নাগরিকের ভিডিওর বাইরে হামলার প্রথম দিকের আরও একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। আর ছবিতো আছেই। সবমিলিয়ে হলি আর্টিজানে হামলা থেকে অভিযান সবকিছু’র একটা চিত্র তদন্তকারীদের কাছে পরিষ্কার হয়েছে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের জবাবন্দির সামান্যই জানি।

তবে এটাই সব নয় হামলার পেছনে আরও অনেক কিছু থাকে। তাই হয়তো আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর এখন খুঁজছেন তদন্তকারীরা।

সেই সব প্রশ্ন আর আর এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে হাসনাত এবং তাহমিদের বডি লাংগুয়েজ মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন। তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ আর আসল ল্যাংগুয়েজ এক কিনা—তা তথ্যের বিচারে মিলিয়ে খুবই জরুরি। আমার মনে হয় এটা করা হলে তাদের প্রকৃত ভূমিকা স্পষ্ট হবে, প্রকৃত অর্থে ছবির মতো।

তাহমিদ কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেখানেও খোঁজ পাঠাতে পারেন তদন্তকারীরা। আর নর্থ সাউথের চাকরি হারানোর পর হাসনাত কী করেছেন, তাও জানা দরকার। হাসনাত সপরিবারে হলি আর্টিজানে জন্মদিন পালনে গিয়েছিলেন বলে দাবি করছেন। তার পরিবারের সদস্যরা সংবাদ মাধ্যমকে নিজেদের উদ্যোগেই নানা তথ্য দিয়েছেন। 

আর তাহমিদের জন্য শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ আন্দোলন ফ্রি তাহমিদ।

তাহমিদের হাতে যে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে, তা উদ্ধার হয়েছে। তাতে তার হাতের ছাপও পাওয়া গেছে ব্যালাস্টিক পরীক্ষায়। কেউ হয়তো বলতে পারেন এইতো মিলে গেছে। কিন্তু না। প্রমাণ হওয়া প্রয়োজন অস্ত্রটি তিনি নিজে নিয়ে হলি আর্টিজানে ঢুকেছেন, না কেউ তাকে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করেছে।আর তাতে গুলি ছিল কিনা? তাহলেই আমরা বুঝতে পারব আসল কাহিনি।

আর পুলিশ যে বলেছে হাসনাত করিম উৎসাহ দাতা, সেটা কি আগে থেকেই, না তিনি তাৎক্ষণিক উৎসাহদাতায় পরিণত হয়েছেন। এটা যদি জানা যায়, তাহলে তার সংযোগের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বোঝা যাবে।

আমরা বুঝতে চাই, জানতে চাই এসব ছবি ও ভিডিওর প্রকৃত ভাষা। তাহলে আর বিভ্রান্তি থাকবে না। ছবি দেখেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মারাত্মক প্রবণতা যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, সেই পরিস্থিতির উপশম হওয়া প্রয়োজন।

তদন্তকারীরা যে তা চেষ্টা করছেন, তা বোঝা যায়। সে কারণেই একমাস দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পরও হাসনাত ও তাহমিদকে গ্রেফতার করে গুলশান হামলায় রিমান্ডে নিয়েছে। আরও নিশ্চিত হতে চায় বলেই গুলাশান হামলায় নয়, তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৫৪ ধারায়। 

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

আরও খবর: হাসনাত-তাহমিদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সঙ্গে তথ্য মিলিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ